সালেহ নোমান
চট্টগ্রাম: এশিয়ায় রুই জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর পানি মিরসরাইয়ে দেশের বৃহত্তম শিল্পাঞ্চলে সরবরাহের পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরনের মত তৈরি হয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত, মানুষের অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে ক্রমান্বয়ে বিপদ বাড়ছে বিরল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের এই নদীর।
৩০ হাজার একরের ওপর বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। এখানে দৈনিক প্রায় ৩০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন পড়বে
পানি সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াসা বলছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে যে পানি সরবরাহ করা হবে তা হালদার মূল প্রবাহের মাত্র এক শতাংশের মত।
তবে, হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া বলছেন, নানা কারণে হুমকির মুখে থাকা এই নদী থেকে স্বাদু পানি প্রত্যাহার হলে, তাতে মাছের প্রাকৃতিক বিচরণ ক্ষেত্র ধ্বংস হতে পারে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর অদূরে বয়ে যাওয়া হালদা নদী থেকে এখন দৈনিক ১৯ কোটি লিটার পানি তুলছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। মোহরারায় নতুন পানি শোধনাগার ইউনিটের জন্য আগামী মার্চ থেকে নেয়া হবে আরো ১৪ কোটি লিটার যা সরবরাহ করা হবে মিরসরাই দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পাঞ্চলে। এর জন্য ৬৫ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপনসহ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্বাবধায়ক প্রপ্রকৌশলী নুরুল আমিন জানিয়েছেন, যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে হালদার পরিবেশ অক্ষত রেখে এই পানি নেয়া হচ্ছে। মিরসরাই শিল্পাঞ্চলে যে পানি সরবরাহ করা হবে, তা হালদার মূল প্রবাহের ১.৩ শতাংশ।
‘ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং আইডাব্লিউএম এর মাধ্যমে যথাযথ জরিপ ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম ওয়াসার এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এতে নদীর মূল প্রবাহ বা প্রাণ বৈচিত্র্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম’, উল্লেখ করেন তিনি।
নুরুল আমিনের মতে হালদার শাখা খালগুলোর মুখে স্লুইস গেইট ও রাবার ড্যাম নির্মাণ করে প্রবাহ আটকানো হয়েছে। বালি উত্তোলন ও তীরে কল-কারখানা স্থাপন করে নদীটির ক্ষতি করা হচ্ছে, এসব বন্ধ হলে হালদা নদীর পরিবেশ আরো ভালো থাকতো।
৮১কিলোমিটার দীর্ঘ হালদা নদীর ভাটিতে শুষ্ক মওসুমে স্বাদু পানির প্রবাহ থাকে প্রতি সেকেন্ডে তিন শ’ ঘন মিটার। এই পানির উৎস হচ্ছে কমপক্ষে ২০ টি খাল, যার কয়েকটির মুখে স্লুইস গেইট দিয়ে পানি আটকে রাখা হয়েছে। ১৪ কোটি লিটারের নতুন প্রকল্প চালু হলে প্রতিদিন হালদা নদী থেকেপানি উত্তোলনের পরিমান দাঁড়াবে ৩৩ কোটি লিটার। যা নদীটির প্রবাহের ৩ শতাংশের মত।

হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া বলছেন, নানা কারণে হুমকির মুখে থাকা হালদা থেকে মাত্রারিক্ত পানি উত্তোলন করা হলে প্রতিবেশগতভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই নদীটির জীব বৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে।
শিল্পাঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য সমুদ্রের পানি লবণাক্ততা মুক্ত করে সরবরাহসহ অনান্য পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণের সুযোগ আছে। এছাড়া বাতাস থেকে জলীয় কণা সংগ্রহের মাধ্যমে পানি উৎপাদনের আধুনিক ব্যবস্থাও আছে, উল্লেখ করেন মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি আরো বলেন, কোন ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা এড়িয়ে প্রাকৃতিক উৎসের পানি ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী ফলাফল বিপদজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
এমনিতে ডলফিন, মা মাছসহ হালদায় বিচরণ করা প্রাণীরা এখন যথেষ্ট বিপদাপন্ন। ২০১৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত ২৮টি মৃত ডলফিন উদ্ধার হয়েছে হালদায়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, জলযানের আঘাতে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণিগুলোর মৃত্যু হয়েছে।
৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটির দুই তীরের বাসিন্দা এবং চট্টগ্রাম শহরের ওয়াসার সরবরাহ করা পানি ব্যবহারকারিসহ হালদার উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি।
প্রাচীনকাল থেকে রুই- কাতলা মাছের পোনা সংগ্রহ হয় হালদা থেকে। বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। আর মাছের পোনা আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে প্রায় ১৫শ মানুষ।