রূপাঞ্জন গোস্বামী
সবচেয়ে সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন। কিনতেন কম, তাঁর কাছে আসা অতিথিদের থেকেই চেয়ে খেতেন বেশি। নিজের জামা কাপড় ছিঁড়লে নিজের হাতে সেলাই করতেন। দর্জিও পয়সা পেত না। তাঁর পরা পোশাক অল্টার করে আবার পরতে হতো বাড়ির কিশোরদের। ছিঁড়ে বা ফেটে না গেলে নতুন জামা বা জুতো বাড়িতে ঢুকতো না।
তাঁর মতো কৃপণ মানুষ, তাঁর আশপাশের কেউ দেখেননি। রাস্তায় বেরিয়ে দোকানে খাবার খেয়ে দাম নিয়ে দোকানদারের সঙ্গে ঝগড়া করতেন। তাঁর আর্দালিদের কেউ কোনও দিন এক সিকি বকশিশ পেয়েছে বলে মনে করতে পারেন না।
সেই মানুষটির টেবিলে কিন্তু পেপার ওয়েট হয়ে শোভা পেত পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম হীরে, ১৮৫ ক্যারেটের জ্যাকব ডায়মন্ড। বর্তমানে যার দাম হাজার কোটি টাকারও বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি রোলস রয়েসের পঞ্চাশটিরও বেশি মডেল রাখা থাকতো তাঁর গ্যারেজে।
তাঁর কাছে যত পরিমাণ মুক্ত ছিল, তাতে একটি অলিম্পিক সাইজের সুইমিংপুল ভর্তি হয়ে যেত। এই মানুষটিই রানি এলিজাবেথের বিয়েতে অক্লেশে কয়েক কোটি টাকা দামি হিরের নেকলেস পাঠিয়ে দেন। যেটি আজও রানির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ‘নিজাম নেকলেস‘ নামে বিখ্যাত।
হ্যাঁ, এই চুড়ান্ত মিতব্যয়ী লোকটিই একসময় ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোক। অবিভক্ত ভারতের হায়দরাবাদ ও বেরার রাজ্যের শেষ নিজাম, স্যর মীর উসমান আলি খান সিদ্দিকি। রাজ্যটি পরাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য ছিল। স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ডকে যুক্ত করলে যা আয়তন হয় তৎকালীন হায়দরাবাদ ও বেরার স্টেটের আয়তন ছিল তার থেকেও বেশি।
নিজামের শাসনে ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ এবং ৮২,৬৯৮ বর্গ মাইল ভূখন্ড ছিল। বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন-এর ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭, সংখ্যার কভারে নিজামের ছবি ছাপা হয়। নিচে ক্যাপশন ছিল, The richest man in the world.
তাঁর ক্ষয়াটে চেহারা, জামা কাপড়ের ছিরি এবং ঝুলো গোঁফ দেখে এক ঝলকে মনে হতো রাজা রাজড়ার রসুইয়ের বাবুর্চি। কিন্তু এই বেঁটে খাটো মানুষটি অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ছিলেন। নিজাম থাকাকালীন তিনিই বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি ছিলেন।
ফরচুন পত্রিকা ১৯৪০ দশকে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ধরে দুই বিলিয়ন ইউএস ডলার। বর্তমানে যার মূল্য দাঁড়াতো কম করে ধরলেও প্রায় চার বিলিয়ন ইউএস ডলার। টাকার মূল্যে প্রায় ২৯৭৪৫ কোটি টাকা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তো ছিলেনই , ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ অবধি তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে ধরা হতো, ১৯৬৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীন হায়দরাবাদ ও বেরার রাজ্যের শেষ নিজাম, স্যার মীর উসমান আলি খান সিদ্দিকি রাজ্যটি শাসন করেছেন ১৯১১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। রাজ্যটিকে রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। ভারতে বা পাকিস্তানের অধীনে রাজ্যটিকে নিয়ে যেতে চাননি।
চেয়েছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গেই জন্ম নিক তৃতীয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। চৌধুরী রহমত আলি যার নাম দিয়েছিলেন ‘উসমানিস্তান‘। কিন্তু ভারত সরকার নিজামের এই সিদ্ধান্ত পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু নাছোড়বান্দা নিজামও।
অবশেষে আলোচনার টেবিলে বিফল হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদ আক্রমণ করে। মেজর জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরীর অধীনে এক ডিভিশন ভারতীয় সেনা ও একটি ট্যাঙ্ক ব্রিগেড হায়দরাবাদে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন পোলো’।
নিজামের পাঁচ হাজার সেনার পক্ষে ভারতের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর স্থল ও আকাশ পথে হামলা প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না। তাই কয়েক ঘণ্টায় হার মানলেন নিজাম। তাঁর হায়দরাবাদ ও বেরার স্টেট ভারতের মানচিত্রে প্রবেশ করল। ভারতে অন্তর্ভুক্তির পর ১৯৫০ সালের ২৫শে জানুয়ারি নিজাম মীর উসমান আলিকে হায়দরাবাদ স্টেটের রাজপ্রমুখ পদে অভিষিক্ত করা হয়। সেই পদে তিনি ৩১শে অক্টোবর ১৯৫৬ পর্যন্ত থাকেন।
আপনার মনে হতে পারে , সাতটি স্ত্রী , চৌত্রিশটা ছেলেপুলে এবং অগনিত রক্ষিতা নিয়ে জীবন কাটানো নিজাম আদৌ সুবিধের লোক ছিলেন না। ভারত বিরোধী ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে হিন্দু বিদ্বেষী একজন কট্টর মুসলিম শাসক ও শোষক হিসেবে দেখিয়েছেন। যদিও ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য তৈরি হওয়া পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর রাজ্যকে যুক্ত করেননি।
তাহলে এবার জেনে নিন , এই মানুষটি, নিজাম মীর উসমান আলি খান সিদ্দিকি ভারতের জন্য কী করে গেছেন। সবার অপছন্দের নিজাম বাহাদুর ভারতের জন্য যেটা করে গেছেন, তা আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারেননি। পারবেনও না।
তখন ১৯৬৫ সাল, ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে চিন। সঙ্গে পেয়েছে দোসর পাকিস্তানকে। দেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে ভারত তৈরি করল জাতীয় নিরাপত্তা তহবিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হায়দরাবাদে গেলেন। নিজামকে অনুরোধ করলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা তহবিলে নিজামকে কিছু দান করার জন্য।
সব শুনলেন কৃপণ নিজাম। মিটি মিটি হাসতে হাসতে নিজের সেক্রেটারিকে ডাকলেন। একটা কাগজে উর্দুতে কী একটা লিখে দিলেন। সেক্রেটারি কাগজটা তুলে চমকে উঠেই নিজেকে সামলে নিলেন। ভারতের নিরাপত্তা তহবিলে নিজাম ওসমান আলি দিলেন ডোনেশন। চমকে গেল বিশ্ব। সামান্যই দিলেন। মাত্র পাঁচ টন সোনা। এর সঙ্গে নগদে দিলেন ৭৫ লক্ষ টাকা।
১৯৬৫ সালে নিজামের দেওয়া পাঁচ টন সোনা, এখনও পর্যন্ত ভারতের জাতীয় কোষাগারে দান হিসাবে দেওয়া সবচেয়ে বড় অর্থরাশি। এতো টাটা, বিড়লা, অম্বানী, আদানি, মিত্তাল এলেন ও গেলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ব্যক্তি তো বটেই কোনও প্রতিষ্ঠানও এতো পরিমাণ সম্পদ ভারতের সুরক্ষা খাতে দান করার বুকের পাটা দেখাতে পারেননি।
এই মানুষটি তাঁর প্রিন্সলি স্টেটের বাজেটের ১১% শিক্ষা খাতে ব্যয় করতেন। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল এবং গরীবদের জন্য নিখরচায় শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। ভারত ও বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি বিশাল অঙ্কের টাকা অনুদান হিসেবে পাঠাতেন।
এর মধ্যে জামিয়া নিজামিয়া, দারুল উলুম দেওবন্দ, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, এমনকি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিও ছিল। তাঁর তৈরি করা ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি আজ ভারতের অন্যতম বৃহৎ ইউনিভার্সিটি। প্রচুর স্কুল, কলেজ, অনুবাদ কেন্দ্র নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন নিজাম।
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিকে ডোনেশন দেওয়া নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। এক হাড়কাঁপানো শীতের রাতে নিজাম শীতে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর আর্দালিকে কম্বল কিনে আনতে বলেন। হিসেবি নিজাম বলে দিলেন কম্বলের দাম ২৫ টাকার বেশি হওয়া চলবে না। তাঁর আর্দালি ২৫ টাকার কম্বল না পেয়ে ফিরে এলেন। কারণ কম্বলের দাম ৩৫ টাকা।
যাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ শুনলে ভির্মি খান রাজারাজড়ারা, সেই নিজাম বাহাদুর, আর্দালির মুখে কম্বলের দাম শুনে পুরোনো কম্বল গায়েই ঘুমিয়ে পড়লেন।
কয়েক ঘন্টা পরে, সকালে উঠেই তিনি বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিকানীরের মহারাজার একটি অনুরোধ পেলেন। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে হিন্দু ছাত্রদের জন্য কিছু সাহায্যের অনুরোধ। একটুও না ভেবে, এক লাখ টাকা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দিলেন সেই মানুষটি। যিনি গতরাত্রে দশ টাকা দাম বেশি হওয়ায় একটি কম্বল কেনেননি।
নিজাম ওসমান গনি ভারতের তৎকালীন সব রাজা মহারাজাদের চেয়ে সব বিষয়েই এগিয়ে ছিলেন। আজ দিল্লিতে যে ঐতিহ্যশালী হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন,এই প্যালেসটি কিন্তু নিজামের অর্থে বানানো।
তাঁর জমানায় তিনি হায়দরাবাদ শহরে তৈরি করেছিলেন তাক লাগানো কিছু প্রাসাদ। যেমন ওসমানিয়া হসপিটাল, হায়দরাবাদ হাইকোর্ট, আসাফিয়া লাইব্রেরি (যেটি এখন পরিচিত স্টেট জেনারেল লাইব্রেরি নামে), টাউন হল (এখন অ্যাসেম্বলি হল নামে পরিচিত), জুবিলী হল, হায়দরাবাদ মিউজিয়াম( বর্তমানে যেটি স্টেট মিউজিয়াম), নিজামিয়া অবজারভেটরি সহ অগনিত প্রাসাদ ও মনুমেন্ট।
তৎকালিন হায়দরাবাদ স্টেটের মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার হাতে খড়ি নিজামের হাতেই হয়েছিল। ১৯১৮ সালে পারভানিতে প্রথম পরীক্ষামূলক ফার্ম গড়ে তোলেন নিজাম। ১৯৪১ সালে তিনি নিজেই নিজের ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন হায়দরাবাদ স্টেট ব্যাঙ্ক। বর্তমানে যার নাম স্টেট ব্যাঙ্ক অফ হায়দরাবাদ। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় হায়দরাবাদই ছিল একমাত্র স্টেট যাকে ব্রিটিশরা নিজস্ব কারেন্সি নোট ব্যবহার করার অনুমতি দেয়।
নিজামের মুদ্রার নাম ছিল, ‘ ওসমানিয়া সিক্কা‘। নোটের নামে ছিল, ‘হায়দ্রাবাদি রুপি‘। নিজামের বিমানের শখও ছিল। তিনি ১৯৩০ সালে ‘হায়দরাবাদ এরো ক্লাব’ এবং বেগমপেট এয়ারপোর্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিমানবন্দর থেকে আকাশে ওড়ে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ব্যবসায়িক এয়ারলাইন্স নিজামের ডেকান এয়ারওয়েজ– এর ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট গুলি।
পাঠক , এবার কি আপনার মনে হচ্ছে না, নিজাম মীর উসমান আলি খান সিদ্দিকি নামক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে সঞ্চয়ী লোকটি হচ্ছেন একাধারে কুবের ও বিশ্বকর্মা! লেখা শেষের আগে বিশ্বের ধনীতম মানুষটির সম্পর্কে আরেকটি বিখ্যাত কাহিনী শুনে নিন।
ভারতীয় নিরাপত্তা তহবিলে দেওয়ার ৫ টন স্বর্ণমুদ্রায় ভর্তি ট্রাঙ্কগুলি যখন ভ্যানে লোড করা হচ্ছে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো নিজাম ভুরু কুঁচকে তাঁর নিজস্ব অফিসারদের বলেছিলেন, ” আমি কিন্তু পাঁচ টন স্বর্ণমুদ্রাই শুধু দান করেছি। ট্রাঙ্ক গুলো নয়। তাই ওগুলো যেন আমার কাছে ফেরত আসে খেয়াল রেখ”।