বিজ্ঞানের মতে কোনও কোনও মানুষের উচ্চতা ও অঙ্গপ্রতঙ্গের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পিছনে আছে মানবদেহের পিটুইটারি গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বৃদ্ধিসহায়ক হরমোনের অস্বাভাবিক ও অত্যধিক ক্ষরণের ফলে কোনও কোনও মানুষের শরীরের উচ্চতা ও অঙ্গপ্রতঙ্গের দৈর্ঘ্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। এটা কিন্তু আদৌ স্বাভাবিক নয়, এটি একপ্রকার শারীরিক অসুস্থতা। কিন্তু এর ফলে মানুষটি পায় দৈত্যর মত চেহারা।
এরকম দৈত্যাকৃতি মানুষের সংখ্যা কিন্তু পৃথিবীতে নেহাত কম নয়। আপনারা হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পর্বতশৃঙ্গের নাম শুনেছেন। আজ চিনে নিন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা ১১ জন মানুষকে। যাঁদের উচ্চতা শুনে, ছবি দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।
ধর্মেন্দ্র প্রতাপ সিং
১১, ধর্মেন্দ্র প্রতাপ সিং (ভারত– উচ্চতা ৮ ফুট ১ ইঞ্চি )
ভারতের সবচেয়ে লম্বা মানুষ। উত্তর প্রদেশের মেরঠে বাড়ি। ছোটবেলায় তাঁকে বন্ধুরা খেপাত উট আর জিরাফ বলে। অস্বাভাবিক লম্বা বলে মহল্লাতেও বেশি বন্ধু জোটেনি। শিক্ষিত ধর্মেন্দ্র ৩২ বছর বয়সেও প্রায় বেকার। তাঁর কোনও স্থায়ী চাকরি নেই। ইন্টারভিউ দিতে গেলে ধর্মেন্দ্রকে একটি প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, “এত লম্বা কাজ করবেন কী করে!” দিনপ্রতি ৫০ টাকা রোজে প্রমোদ উদ্যানে কাজ করেছেন। পার্কে তাঁর সঙ্গে কেউ ছবি তুলতে গেলে ১০ টাকা নেন। কেউ দেন, কেউ না দিয়ে পালিয়ে যান।
মোর্তেজা মেহেরজাদ
১০, মোর্তেজা মেহেরজাদ (ইরান, উচ্চতা ৮ ফুট ১ ইঞ্চি)
জন্ম ১৯৮৭ সালে। ১৬ বছর বয়সে উচ্চতা দাঁড়ায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। দারুণ ভলিবল খেলতেন। দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় হুইলচেয়ারে বন্দি হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই অবস্থাতেই তাঁর প্রিয় ভলিবল খেলা চালিয়ে যান। প্যারা-অলিম্পিকে নামেন ইরানের হয়ে। প্যারা-অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা খেলোয়াড় মোর্তেজা। বর্তমান পৃথিবীতে উচ্চতার দিক থেকে মোর্তেজা দ্বিতীয় লম্বা মানু্ষ, যিনি এখনও জীবিত।
ব্রাহিম তাকিউল্লাহ
৯, ব্রাহিম তাকিউল্লাহ ( মরক্কো, ৮ ফুট ১ইঞ্চি)
মরক্কোর এই মানুষটির জন্ম ১৯৮২ সালে। গিনেস রেকর্ড অনুযায়ী জীবিত মানুষদের মধ্যে উচ্চতায় যুগ্ম দ্বিতীয় স্থানে আছেন ব্রাহিম, মোর্তেজা মেহেরজাদের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় পায়ের পাতার বিশ্বরেকর্ডও ব্রাহিমের দখলে। এঁর পায়ের পাতা ১৫ ইঞ্চি লম্বা। টিভির বিজ্ঞাপন ও সিনেমায় অভিনয় করেন।
জেং জিনলিয়ান
৮, জেং জিনলিয়ান (চিন, উচ্চতা ৮ ফুট ১.৭৫ইঞ্চি)
চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মহিলা হিসেবে লেখা আছে জেং জিনলিয়ানের নাম। জন্ম ১৯৬৪ সালে। চার মাস বয়সে তাঁর উচ্চতা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। ৪ বছরে উচ্চতা দাঁড়ায় ৫ ফুট ১.৫ ইঞ্চিতে। ১৩ বছর বয়সে ৭ ফুট ১.৫ ইঞ্চি, ১৬ বছর বয়সে ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতা হয় জেংয়ের। চিনের হুনান প্রদেশের ইউজিয়াং গ্রামের জেং জিনলিয়ান মারা যান ১৯৮২ সালে। কিন্তু তাঁর রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেননি।
ডন কোয়েলার
৭, ডন কোয়েলার ( আমেরিকা, উচ্চতা ৮ ফুট ২ ইঞ্চি)
১৯২৫ সালে জন্ম ডন কোয়েলারের। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ডন কোয়েলার ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা জীবিত মানুষ। যৌবনে ‘হার্লেম গ্লোবট্রটার’ নামে বিশ্বখ্যাত বাস্কেটবল টিমে খেলার সুযোগ পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
মৃত্যুর আগে kyphosis রোগে মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছিল। তবুও তাঁকে দুটো খাট জুড়ে নিয়ে শুতে হত। ১৯৮১ সালে ৫৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শিকাগোতে মারা যান।
সুলতান কোসেন
৬, সুলতান কোসেন ( তুরস্ক, উচ্চতা ৮ ফুট ২ ইঞ্চি)
জন্ম ১৯৮২ সালে। অত্যধিক লম্বা হওয়ার জন্য সুলতানের পড়াশোনা অল্পবয়সে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ স্কুল, স্কুলের বেঞ্চ, সহপাঠী ও শিক্ষকদের মনোভাব তার মতো অস্বাভাবিক লম্বা ছাত্রের পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। তাই পরিবারের লোকদের সঙ্গে চাষ আবাদের কাজে যোগ দেয় সুলতান। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ডের মতে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে লম্বা জীবিত মানুষ সুলতান। আরও একটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড আছে। সুলতানের হাতের পাতাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়, দৈর্ঘ্যে ১১.২ ইঞ্চি।
এডুয়ার্দো বিউপ্রে
৫ এডুয়ার্দো বিউপ্রে (কানাডা, উচ্চতা ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি)
এডুয়ার্দোর জন্ম ১৮৮১ সালে। ১১ বছর বয়সে এডুয়ার্দো বিউপ্রের উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি, ১৭ বছর বয়সে ৭ ফুট ২ ইঞ্চি। Barnum and Bailey নামে এক বিখ্যাত সার্কাসে শক্তি প্রদর্শনের খেলা দেখাতেন, লোহার রড বেঁকিয়ে ও কাঁধে ঘোড়া তুলে। পেশাদার কুস্তিগীরও ছিলেন। ১৯০৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে যক্ষা রোগে মারা যান।
ভিনো মাইলিরিনে
৪, ভিনো মাইলিরিনে ( ফিনল্যান্ড, ৮ফুট ৩ ইঞ্চি)
১৯০৯ সালে জন্ম এই মানুষটির। তাঁর জীবদ্দশায় তিনিই ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা জীবিত মানুষ। ২১ বছর বয়সে তাঁর উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ৪ ইঞ্চি। ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। সে দেশের সর্বকালের সবচেয়ে লম্বা সেনা হিসেবে তাঁর রেকর্ড আজও অটুট। শক্তিশালী এই মানুষটি হেভি-মেশিনগান দুই হাতে তুলে চালাতেন। পরে পেশাদার কুস্তিগীর হয়েছিলেন। ইউরোপে ঘুরে ঘুরে কুস্তি লড়তেন। ভিনো মারা যান ১৯৬৩ সালে।
জন এফ ক্যারল
৩, জন এফ ক্যারল ( আমেরিকা, উচ্চতা ৮ ফুট ৭.৫ ইঞ্চি)
আমেরিকার বাফেলোতে জন্মান ১৯৩২ সালে। মেডিক্যাল জার্নালে তাঁকে Buffalo Giant বলা হত। ১৬ বছর বয়সে তাঁর উচ্চতার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শুরু হয়। একটা সময়ে নাকি এক মাসে তাঁর উচ্চতা বেড়েছিল ৭ ইঞ্চি । তাঁর মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল kyphoscoliosis রোগে। তাই তাঁর সঠিক উচ্চতা মাপা তখন কঠিন ছিল। কিন্তু তাঁর উচ্চতা ৯ ফুটের কিছু কম ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৬৯ সালে ৩৭ বছর বয়সে মারা যান জন এফ ক্যারল।
জন রোগান
২, জন রোগান ( আমেরিকা, উচ্চতা ৮ ফুট ৯ ইঞ্চি)
পৃথিবীর ইতিহাসে উচ্চতার দিক থেকে দ্বিতীয় লম্বা মানুষ। ১৮৬৮ সালে আমেরিকার টেনেসিতে জন্মেছিলেন এই ক্রীতদাস পুত্র। হাঁটতে পারতেন না। কিন্তু খুব ভাল ছবি আঁকতেন। রেলস্টেশনে নিজের আঁকা ছবি ও পোস্টকার্ড বিক্রি করতেন। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাঁকে তাচ্ছিল্য করে ডাকা হত ‘negro giant‘। ১৯০৫ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মারা যান অসামান্য এই মানুষটি।
রবার্ট ওয়াডলো
১, রবার্ট ওয়াডলো (আমেরিকা–উচ্চতা ৮ ফুট ১১ ইঞ্চি))
জন্ম হয় ১৯১৮ সালে। মাত্র একবছর বয়সে রবার্টের উচ্চতা হয় ৩ ফুট ৫ ইঞ্চি। আট বছর বয়সে তাঁর উচ্চতা হয় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে রবার্ট পেয়েছিলেন সেই সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা জীবিত মানুষের তকমা। স্নাতক হওয়ার সময় রবার্টের উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ৪ ইঞ্চি। খেলাধূলা, পড়াশোনা সবই করেছেন স্বাভাবিকভাবে। নিজের পায়েই হাঁটতেন।
ভদ্র ও বিনয়ী এই মানুষটিকে সবাই ডাকতেন gentle giant নামে। ১৯৪০ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে মারা যান পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা মানুষ রবার্ট ওয়াডলো। আজও যাঁর ব্রোঞ্জ মূর্তি আছে আমেরিকার ইলিনয়ের অলটনে, মোমের মূর্তি Ripley’s Believe It or Not এর মিউজিয়ামে।