Home কৃষি নদীর বুকে সবজির হাট

নদীর বুকে সবজির হাট

ভাসমান সবজির হাট

আল-আমিন হোসাইন, নাজিরপুর (পিরোজপুর): ৬৫ বছর ধরে স্থানীয় ২০ থেকে ২৫ গ্রামের কৃষকেরা ক্ষেতের সবজি, ধান, চাল ও তরিতরকারী কেনাবেচা করছেন এ ভাসমান হাটে। সরেজমিন দেখা গেছে, সূর্যোদয়ের পর বেলুয়া নদীর আশপাশের এলাকার খাল বেয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কৃষক সবজি নিয়ে ভাসমান হাটে যাচ্ছেন। সকাল ৭টার মধ্যে হাট সরগরম হয়ে ওঠে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে নদীর বুকে বসে ভাসমান সবজির হাট। নদীর বুকে নৌকায় নৌকায় করে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন প্রকারের তর-তরকারির বেচাকেনা। দুপুর গড়ালেই আবার ভেঙে যায় এ ভাসমান সবজির হাট।
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বসে ভাসমান এ হাট। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলেমিটার দূরে বেলুয়া নদী। বৈঠাকাটা বাজার ও বেলুয়া মুগারঝোর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এ নদী। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ট্রলার ও বড় নৌকা নিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিচ্ছেন। এ ভাসমান হাটে বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ, আলু, মিষ্টি কুমড়া, শিম, লাউ, করলা, কচু ও নানা জাতের শাকসবজি নিয়ে কৃষকরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দর হাঁকছেন। সবজির পাশাপাশি হাটে বিক্রি হয় শাকসবজি ও ফুলের চারা। হাটের এক পাশে রয়েছে ধান, চাল, ডাল, পিয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, তৈল, মসলা, মুড়ি ও নারিকেল বিক্রির স্থান। তা ছাড়াও বাজারে হালকা খাবার ও সকালের নাস্তা পাওয়া যায়।
উপজেলার মুগারঝোর গ্রামের কৃষক আবু বক্কর (৪২) বলেন, আমাদের গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবার ক্ষেতে শীতকালীন সবজি চাষ করে। কৃষক তার উৎপাদিত সবজি বেলুয়া নদীর ভাসমান হাটে বিক্রি করেন। এ হাটে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় আশপাশের গ্রামের কৃষকরাও এখানে পণ্য বিক্রি করতে আসেন। এখান থেকে কৃষিপণ্য কিনে পাইকাররা রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলা, উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন। সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী রাসেল মোল্লা বলেন, বৈঠাকাঠা বাজার থেকে আমি সবজি কিনে ট্রলারে করে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করি। প্রতি হাটে সাত-আট লাখ টাকার সবজি কেনাবেচা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, পঞ্চাশের দশকের শুরুতে মুগারঝোর গ্রামের সেকান্দার আলী সরদার, প্রয়াত কেরামত আলী, দলিল উদ্দিন সরদার ও আবুল কাশেম তালুকদার বৈঠাকাটা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৪ সালে বৈঠাকাটা বাজারের পাশে বেলুয়া নদীতে ভাসমান হাট বসা শুরু করে।
উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, মুগারঝোর, মনোহরপুর, গাঁওখালী, চাঁদকাঠি, ডুমুরিয়া, সাচিয়া, লড়া, বইবুনিয়া, পেনাখালী, নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া, গগন, মলুহার, কাটাখালী, উলুহার, জনতা, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি, উমারেরপাড়, উদয়কাঠি, কদমবাড়ি, বাইশাড়ি, চৌমোহনাসহ আশপাশের আরো কয়েকটি গ্রামের কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য এ হাটে বিক্রি করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা হাট থেকে কৃষিপণ্য কিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে নিয়ে যান। বৈঠাকাটা বাজার কমিটির সমন্বয়ক সাবেক ইউপি সদস্য সুলতান মাহমুদ জানান, এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। প্রতিটি কৃষক পরিবারে একটি করে নৌকা ছিল। বাজার প্রতিষ্ঠার পর আশপাশের গ্রামের কৃষকরা নৌকায় করে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য হাটে নিয়ে আসতেন। ক্রেতারা কৃষিপণ্য কেনার জন্য নৌকায় করে হাটে আসা যাওয়া করতেন। বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে নৌকায় বসে চলত বেচাকেনা। এভাবে নৌকা থেকে নৌকায় পণ্য বেচাকেনা করতে করতে ভাসমান হাটের শুরু হয়। উপজেলার ৯নং কলারদোনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসনাত ডালিম জানান, এ অঞ্চলের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষক। স্থানীয় কৃষকদের পণ্য বৈঠাকাটা ভাসমান হাটে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয়। এ হাটের কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন এলাকা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। সারা বছর ধরে হাটে কেনাবেচা হলেও শীত মৌসুমে হাটটি বেশি জমজমাট থাকে।