ড. আহমেদ আবদুল্লাহ
ইংরেজ সম্প্রদায় বঙ্গদেশে বাবসা-বাণিজ্য সম্পন্ন করার অভিপ্রায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সংঘ নাম ধারণ করে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অনুমােদন লাভ করে।
মূলত এদেশে ইংরেজ গােষ্ঠী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট হতে এতদঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করার স্বীকৃতি অর্জন করে এবং ১৬৬৩ সালে তারা সর্বপ্রথম গুজরাটের বাণিজ্য বন্দর সুরাটে তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
কিন্তু এই অনুমােদন যে এক সময় সর্বাঙ্গীন অভিশাপে পরিণত হবে সম্রাট জাহাঙ্গীর বোধকরি সে কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। পরবর্তী ইতিহাস ইংরেজ সম্প্রদায়ের নিরবচ্ছিন্ন বিজয়ের ইতিহাস।
ইংরেজী গোষ্ঠীর নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কোন পথে এগুতে হবে তা বোধকরি অজানা ছিল না। তাই তো পরবর্তী সময়কালে সুচতুর ইংরেজ গােষ্ঠীর ক্ষমতালােভী উচ্চাকাঙ্খী আমীর ওমরাহাদের ইন্ধন যােগাতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালে এদেশের কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ নামক প্রহসনের মধ্য দিয়ে ওরা এদেশের সর্বময় অধিকর্তা হয়ে বসে। অতঃপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্বজাতীয় আধিপত্য বিস্তারে মনােনিবেশ করে।
সেদিনের মুসলমান সম্প্রদায়ের ধারণা ছিল ইংরেজ জাতির ব্যবসায়িক মনােবৃত্তি ব্যতীত আদৌ কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু মুসলমানদের এই ধারণা ভেঙ্গে যেতে খুব বেশী সময় লাগেনি।
ক্ষমতায় আরােহণ করেই ইংরেজ সম্প্রদায় একের পর এক মুসলিম শোষণের অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে। এসময় মুসলমান সমাজে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজ গােষ্ঠীও তাদের শত্রু চিনতে ভুল করেনি।
মুসলমানদের নিকট হতে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার পর ইংরেজ শাসকগােষ্ঠী স্বভাবতই মুসলমানদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে তাদের জাতশত্রু হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এ সময় ইংরেজগণ এটুকু স্পষ্টতই অনুধাবন করে যে, যাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের দমিয়ে রাখতে না পারলে এদেশে তাদের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
এজন্য প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এদেশীয় একটি গােষ্ঠীর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। এই লক্ষ্য অর্জনেই ইংরেজ সম্প্রদায় এদেশীয় কতিপয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্রতী হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য এমএন রায়ের ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে।
ইংরেজ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের এই বন্ধুত্বের ভিত্তিতে মুসলমানরা উভয় সম্প্রদায়ের বৈরী শত্রুতে পরিণত হয়। ঠিক এহেন পরিস্থিতিতে কতিপয় মুসলমান স্পষ্টতই অনুধাবন করেন যে, এদেশ থেকে ওই ফিরিঙ্গী, বেনীয়া ইংরেজ গােষ্ঠী বিতাড়ন ব্যতীত বাংলায় মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা কার্যত অসম্ভব। অন্যদিকে চতুর , ইংরেজরা অনুধাবন করল, আর্থিক সচ্ছলতাই একটি জাতির শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের মূল উৎস। এজন্য তারা প্রথমেই মুসলমানদের আর্থিক সচ্ছলতাকে নস্যাত করে দিতে একের পর এক নানাবিধ চক্রান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার প্রচলন। ক্ষমতা লাভের অব্যবহিত পরই ইংরেজরা এদেশের রাজস্ব বা দেওয়ানী ব্যবস্থার সংস্কার সাধনে তৎপর হয়। ইংরেজরা এসময় ১৭৮৮- ১৭৯৩ পর্যন্ত দেওয়ানী ব্যবস্থার নানাবিধ অপসংস্কার সাধন করে।
এই অপসংস্কারের মধ্য দিয়ে একদিকে মুসলমানরা যেমন তাদের জমিদারী হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল অন্যদিকে ইংরেজদের অনুগ্রহে হিন্দু জমিদার গােষ্ঠীর গােড়াপত্তন ঘটল। (দেখুন, দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমান, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার, পৃঃ ১২০) কেবল তাই নয়, বাদশাহী আলম থেকে এদেশের মুসলমান পরিবার লাখেরাজ সম্পত্তি ভােগ করে আসছিল। এসব সম্পত্তির আয় হতে মুসলমানদের নানাবিধ সামাজিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ চলত। ১৭৯৭ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত আইনের মাধ্যমে মুসলমানদের সমস্ত লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘােষণা করেন।
-লেখক: জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক