ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বৃটেনের বিচ্ছেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। নিজের ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে পার্লামেন্টে পরাজয়ের মুখ দেখে ডাক দিয়েছিলেন আগাম নির্বাচনের। তার কৌশল ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছে তার নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। যেখানে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২৬ আসন, সেখানে তার দল পেয়েছে ৩৬৪টি। গত নির্বাচনে তাদের দখলে ছিল ৩১৭ আসন। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত একটি আসনের ফলাফল অঘোষিত ছিল। দলের এই জয় একটি বার্তাই স্পষ্ট করেছে- ব্রেক্সিট হচ্ছে।
দলের জয় উদযাপনে দেয়া এক ভাষণে জনসন জানান, ভোটারদের বিশ্বাসের যথাযথ প্রতিদান দেবেন তিনি। প্রতিশ্রুত সময়ে ব্রেক্সিট সরবরাহ করবেন। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। সাক্ষাতে সরকার গঠনের অনুমতি চাইবেন ক্ষমতাসীন এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তিনি জনগণের সরকারের নেতৃত্ব দেবেন।
এদিকে, কনজারভেটিভ পার্টির ঐতিহাসিক জয়, প্রধান বিরোধীদল লেবার পার্টির ঐতিহাসিক পরাজয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০৩ আসনে জয়লাভ করেছে জেরেমি করবিনের দল। আসন হারিয়েছে প্রায় ৬০টি। দলের পরাজয় মেনে নিয়ে প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন করবিন। জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনের আগেই দলপ্রধান হিসেবে পদত্যাগ করবেন তিনি। তবে এই অবস্থা থেকে দলের উত্তরণের জন্য ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে জানান লেবার নেতা।
লেবারের পাশাপাশি বাকি বিরোধী দলগুলোর বেশিরভাগের অবস্থাই নিম্নগামী। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা এক আসন হারিয়ে জিতেছে ১১ আসনে। নিজ আসনে পরাজিত হয়ে পদত্যাগ করেছেন দলের প্রধান জো সুইনসন। কোনো আসনেই জেতেনি ব্রেক্সিট পার্টি। ব্রেক্সিট সমর্থকদের ভোট বিভক্ত না করতে কনজারভেটিভদের দখলে থাকা ৩১৭ আসনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলটির নেতা নাইজেল ফারাজ। কনজারভেটিভদের নিরঙ্কুশ জয়ের পেছনে ফারাজের ভূমিকা অসামান্য। এদিকে, ডিইউপি দুই আসন হারিয়ে ধরে রেখেছে ৮ আসন। তবে বিরোধীদের মধ্যে অপ্রত্যাশিত ফলাফল করেছে নিকোলা স্টার্জন নেতৃত্বাধীন স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি)। গত বারের চেয়ে ১৩ আসনে বেশি জয়ী হয়েছে দলটি। ইংল্যান্ডে লিবারেল ডেমোক্র্যাটের শক্ত ঘাঁটিতে থাবা বসিয়ে তা ছিনিয়ে এনেছে। সব মিলিয়ে মোট ৪৮ আসনে জয়ী হয়েছে এসএনপি। এতে তাদের স্কটিশ স্বাধীনতার দাবি আরো জোরদার হলো।
বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৭.৩ শতাংশ। মোট নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৪ জন।
বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের ফলাফলে একটি বিষয় নজর কেড়েছে। তা হলো, কনজারভেটিভদের কাছে বহু আসন হারিয়েছে লেবার। উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে লেবারকে হটিয়ে স্থান করে নিয়েছে জনসনের দল। এই নির্বাচন অবশ্য জনসনের জন্য অবিস্মরণীয় জয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে টানা পরাজয়ের মুখ দেখছিলেন তিনি। পার্লামেন্টে বারবার চেষ্টা করেও নিজের ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। আগাম নির্বাচন ডেকে পুরো পরিস্থিতিই নিজের অনুকূলে পাল্টে নিলেন কনজারভেটিভ এ নেতা।
এদিকে, জনসনের জন্য বড় জয় হলেও, বৃটেনের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। জনসন ২০২০ সালের মধ্যে ব্রেক্সিট ও ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য আলোচনা শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন তেমন সম্ভব হবে না। এতে বরঞ্চ চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের মতো বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে সবখানে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিতই মিলছে। কনজারভেটিভদের জয়ের প্রভাব পড়েছে বাজারে। ডলার ও ইউরোর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে পাউন্ডের দাম।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক টনি ট্রেভার্স জনসনের জয় নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এটা চমকপ্রদ জয়। বরিস জনসনের হাতে এখন পাঁচ বছর ক্ষমতা থাকবে। অন্যদিকে, লেবার ফের তাদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
কনজারভেটিভদের জয় বৃটেনের বিগত প্রায় ৪ বছরের জরা অবস্থা ভাঙতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটের পর থেকে দেশটির পার্লামেন্ট এ বিষয়ে এক দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে দুই প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগও করেছেন। আড়াই বছর হয়ে গেছে দুই নির্বাচন। কিন্তু এখন জনসনের হাতে যেকোনো বিল পাস করার সক্ষমতা রয়েছে। নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তার নেতৃত্বাধীন দলের দখলে। যেকোনো বিল পাস করাতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
জনসনের শীর্ষ সহযোগীদের একজন হচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি পাটেল। তিনি বৃহসপতিবার সন্ধ্যায় জানান, জনসন বড়দিনের আগেই নতুন একটি বিল পাসের পরিকল্পনা করছেন। এতে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। বর্তমান চুক্তি অনুসারে, আগামী ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে ব্রেক্সিট চুক্তি সমপন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর ২০২২ সালের মধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে সকল প্রকার বাণিজ্যিক আলোচনা শেষ করার কথা রয়েছে। তবে জনসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ২০২০ সালের মধ্যেই আলোচনা শেষ করবেন। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে আলোচনা শেষ হওয়া সম্ভব নয়।
এই নির্বাচনের পুরোটাজুড়েই ছাপিয়ে ছিল ব্রেক্সিট। লেবার চেয়ারম্যান ইয়ান ল্যাভেরি নির্বাচনে দলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে ব্রেক্সিট বিরোধী প্রচারণাকেই দায়ী করেছেন। তিনি মনে করেন, অত্যধিক মাত্রায় ব্রেক্সিট বিরোধী অবস্থানের কারণেই এই বিপর্যয়কারী হার দেখেছে লেবার। বিবিসি রেডিও ৪-এর টুডে প্রোগ্রামে ইয়ান ল্যাভেরি বলেছেন, ২০১৭ সালের নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের মধ্যে মাত্র একটিই পার্থক্য আছে। তাহলো, লেবার পার্টি আরেকটি ব্রেক্সিট গণভোটের পক্ষ নিয়েছিল।