সালেহ নোমান
ভাসান চর থেকে
বঙ্গোপসাগরের ভাসান চরকে ঘিরে দেশের বৃহত্তম কৃষি ভিত্তিক খামার গড়ে উঠার সম্ভাবনা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চলছে। সেখানে পরিচালিত প্রায় সব ধরনের গবাদি পশু লালন-পালনের পরীক্ষামূলক কর্মকান্ডে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে।
২০ বছর আগে জেগে উঠা ভাসান চরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে আশ্রায়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে এক লক্ষ বলপূর্বক বাস্তুচ্যূত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা যাবে। রোহিঙ্গারা না গেলে অথবা তারা ফিরে গেলে সেখানে স্থানীয় ভূমিহীনদের পূনর্বাসনের কথা বলা হচ্ছে।
এই আবাসন প্রকল্প নির্মাণের জন্য ১৭০২ একর জায়গাকে ভেড়ি বাধ নিয়ে নিরাপদ করা হয়েছে, যার ৪৩২ একর ভূমিতে এক লক্ষ মানুষের বসবাস উপযোগি ১২০টি ক্লাষ্টার হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। বেড়ি বাঁধের ভিতরে আরো কমপক্ষে দুই লক্ষ মানুষের আবাসন করা যাবে একই পদ্ধতিতে।
ভাসান চরের দৈর্ঘ উত্তর দক্ষিনে প্রায় ৭.৫ কিলোমিটার এবং পূর্ব- পশ্চিমে ৬.৫ কিলোমিটার। বর্তমানে এই দ্বীপে ভূমির পরিমান প্রায় ৩০ হাজার একর। এর মধ্যে এখন ব্যবহার উপযোগি ৬৪২৭ হাজার একর। ভাসান চর মূলত একটি খাল দিয়ে দুইভাগে বিভক্ত। এর দক্ষিনের ক্ষুদ্র অংশের আয়তন ২ হাজার একর।
বর্তমানে চরটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে, যার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ মূলত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। এটিকে নোয়াখালি জেলার হাতিয়া উপজেলার চর ঈশ্বর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও এই চর চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থেকে পাঁচ কিলোমিটার এবং হাতিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
ভাসান চরে পরীক্ষামূলক গবাদি পশু পালনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো তাতে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে। সেখানে, গরু, ভেড়া, মুরগি, টার্কিশ মুরগী, হাঁস ও কবুতর লালন পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলো নৌ বাহিনীর সদস্যরা।
গত সপ্তাহে সরেজমিনে এই চর পরিদর্শন কালে নৌবাহিনীর বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে শুধুমাত্র টার্কিশ মুরগী ছাড়া অন্যসব প্রানীই সেখানে টিকে গেছে এবং ফলনও ভালো দিচ্ছে। সেখানার পরীক্ষামূলক খামারে এখন প্রায় ৩শ’ ভেড়া, একশ’ মুরগি, ১শ’ কবুতর, ৫০টি হাঁস আছে।
এছাড়াও খামারে আছে খরগোশ। দুই বছর আগে শুরু হওয়া এই খামারে সবগুলো প্রাণীই ভালোভাবে ডিম দিচ্ছে এবং প্রাকৃতিক উপায়ে বংশ বৃদ্ধি করছে।
সেখানকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এরমধ্যে যতগুলো প্রাণী লালন- পালন করা হয়েছিলো, তার মধ্যে শুধুমাত্র টার্কিশ মুরগি ঠিকভাবে টিকে থাকেনি। আর অন্যসব প্রানীই ভালোভাবে টিকে গেছে।
ভাসান চরে নৌবাহিনীর তৎপরতা শুরুর আগে থেকেই মহিষ লালন পালন হতো। বর্তমানে সেখানে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মহিষ পালিত হচ্ছে। এছাড়া আবাসন প্রকল্প নির্মাণ শুরুর পর সেখানে গরু পালন শুরু হয়। বর্তমানে এই চরে সাড়ে পাঁচ শ’ গরু আছে।
ভাসান চরকে ঘিরে দেশের বৃহত্তম গবাদি পশুর লালন পালন কেন্দ্র গড়ে উঠার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে বলে সেখানকার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। পরিকল্পিত উপায়ে চরকে প্রাকৃতিক দু্র্যাগের ঝুঁকিমুক্ত রাখা গেলে এই চরের আশপাশের ভূমি দেশের খাদ্য চাহিদা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
সরেজমিন দেখা গেছে ভাসানচরের চারপাশে তৈরি করা হয়েছে শক্তিশালী বাঁধ। আছে ম্যানগ্রোভ বন। গত ১৭৬ বছরের দুর্যোগের ওপর সমীক্ষা চালানো বিদেশি পরামর্শক এইচ আর ওয়ালিংফোর্ডের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় বড় আকারের জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন হতে দ্বীপের স্থাপনাসমূহ আরোও সুরক্ষিত রাখতে ৯ ফুট হতে ১৯ ফুট উচ্চতায় বাঁধ বর্ধিতকরণ প্রকল্প চলমান আছে।
এই আবাসন তৈরিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিবেশকে। সেজন্য প্রকল্প এলাকায় রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত জলাধার। পরিবেশ সম্মত, আধুনিক ও টেকসই সরঞ্জামে তৈরি প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজেও রয়েছে একটি করে জলাধার। ভাসান চরের ভূগর্ভস্থ পানি সুমিষ্ট এবং অল্প গভীরতায় সেখানকার নলকূপগুলো স্বাদু পানির নাগাল পাচ্ছে।
চরে গবাদি পশু লালন পালন ছাড়াও পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন ফসল, ফল ফলাদি এবং সবজির চাষ হচ্ছে। তবে, ভূমির লবনাক্ততার কারণে চাষাবাদ শুরুর দিকে কষ্টকর হলেও সময় যত যাচ্ছে ততই সেখানকার মাঠি চাষাবাদের উপযুক্ত হচ্ছে। চরে ধান চাষ ছাড়াও কলা, বিভিন্ন ধরনের সবজি এমনকি বিদেশি ড্রাগন ফলের চাষও করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ভাসানচরের মূল অংশ চাষাবাদের জন্য সংরক্ষিত রেখে খাল দিয়ে বিভক্ত দক্ষিণ অংশ গরু- মহিষ লালন- পালনের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে।
ভাসান চরে দুর্যোগ মোকবেলায় মোটামুটি টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পাওয়া গেছে। গত এক বছরের ঝড় জলোচ্ছাসে সেখানে বেড়িবাঁধের ভিতরে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেনি।
সেখানকার আবাসন প্রকল্পে যে ১২০টি ৩ তলা বিশিষ্ট সাইক্লোন সেল্টার আছে তার নীচ তলায় কয়েক হাজার গবাদি পশু দুর্যোগে আশ্রয় নিতে পারবে।
নৌবাহিনীর চারটি এলসিইউ ও ৮টি জলযান ও দুটি হেলিপ্যাডের মাধ্যমে জরুরি প্রয়োজনে দিন রাত মানুষ স্থানান্তর করার ব্যবস্থাও আছে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে।