বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
ইশ্বরদী : সুদসহ পরিশোধের পরও কারো বকেয়া ছিল ৪০০, কারো ৯০০ টাকা। তারপরও বকেয়া ঋণের দায়ে জেল খাটতে হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদীর ভাড়ইমারী গ্রামের কৃষকদের।
সোমবার তদন্ত কমিটি এ বিষয়ে ভাড়ইমারী গ্রামে অনুসন্ধানে গিয়ে এসব তথ্য জানতে পারে।
সমবায় ব্যংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপির দায়ে মামলায় অভিযুক্ত ভাড়ইমারি গ্রামের ৩৭ কৃষক বিষয়ে গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদন্ত করেছেন।
সোমবার (৫ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তদন্ত কমিটির তিন সদস্য ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামে কৃষকদের বাড়িতে যান।
তিন সদস্যের এই তদন্ত দলের প্রধান হলেন, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও আইন) মো. আহসানুল গণি। অপর দুজন হলেন, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প ও ঋণ) আবদুর রাজ্জাক ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক (আইন) আমিনুল ইসলাম। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন, ব্যাংকটির পাবনা শাখার ব্যবস্থাপক কাজী জসিম উদ্দীন। সেখানে উপস্থিত তিন কৃষক আব্দুস সামাদ, মজনু প্রামাণিক ও আতিয়ার রহমানের সঙ্গে কথা বলেন তারা।
কারাভোগের শিকার কৃষক আব্দুস সামাদ বলেন, সব টাকা পরিশোধ করেছি। তারপরও কেন আমাকে তিনদিন কারাগারে থাকতে হলো। এর দায়ভার ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। হয়রানির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
ভাড়ইমারী উত্তরপাড়া সবজি চাষি সমবায় সমিতির সভাপতি বিলকিস নাহার জানান, ব্যাংকের মাঠকর্মীরা এখানে এসে কৃষকের নিকট থেকে কিস্তি গ্রহণ করেছেন। এ কিস্তির টাকা মাঠ কর্মীরা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন কিনা আমি জানি না। সমবায় ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করবে, এটা বেশ ভালো উদ্যোগ। তবে কৃষকেরা আগেই বলেছেন, তাদের কাছে ঋণ পরিশোধের কোনো কাগজ নেই। গ্রামের কৃষকেরা এসব কাগজের প্রয়োজনীয়তা বোঝেন না। তারা অনেকেই ঋণের টাকা জমা দেওয়ার পর রসিদ সংরক্ষণ করেননি। ঋণ পরিশোধের এ সব তথ্য ব্যাংকের কাছেই সংরক্ষিত আছে। আমার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির একটি মামলা করেছে ইতিপূর্বে। সেই মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিয়ে আসছি।
উল্লেখ্য, ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারি গ্রামে ‘ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমবায় সমিতি’ নামের কৃষকদের একটি সমিতি আছে। এই কৃষকরা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নেন। কৃষকদের দাবি, তারা এ ঋণের ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সমবায় ব্যাংক আরও ১৩ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে এবং ঋণের শর্তভঙ্গের দায়ে প্রতারণার মামলা করে। মামলায় আদালত ৩৭ কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ১২ কৃষককে গ্রেফতার করে গত ২৫ নভেম্বর আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়।
কমিটির সদস্যরা ঋণখেলাপী কৃষকদের বাড়ি যান। তারা কৃষকদের কাছে জানতে চান, ঋণের টাকা কেন তারা পরিশোধ করেননি? ঋণের কিস্তি পরিশোধের রশিদ আছে কিনা এবং কার কাছে তারা কিস্তির টাকা জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া মামলা দায়েরের আগে ব্যাংক তাদের ঋণ পরিশোধের কোন নোটিশ দিয়েছে কিনা।
তদন্ত দলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ঋণের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া ৩৭ কৃষকের মধ্যে আতিয়ার রহমান ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সুদসহ ৪৯ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তার বকেয়া রয়েছে মাত্র ৪৩৩ টাকা। এরপরও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মোছা. রহিমা বেগম নামের এক নারী ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৪৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তার বকেয়া রয়েছে ৯০০ টাকা। মজনু প্রামাণিক নামে অপর একজন ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৫৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন।
তদন্ত দল কৃষকদের কাছে ঋণ পরিশোধের প্রমাণ চাইলে কৃষকেরা তারা তেমন কোনো রশিদ দেখাতে পারেননি। তবে তারা মুখে মুখে পরিশোধের হিসাব ও তারিখ জানান। সেসব তথ্য ব্যাংকের স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলে যায়। এ সময় কয়েকজন নিজেদের সামান্য বকেয়ার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা তদন্ত দলের কাছে প্রশ্ন তোলেন, টাকা পরিশোধ করে কেন জেল খাটতে হল? কৃষকদের এ প্রশ্নে তদন্ত দলের সদস্যরা চুপ হয়ে যান।
গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগের শিকার কৃষক আব্দুস সামাদ বলেন, সব টাকা পরিশোধ করেছি। তারপরও কেন আমাকে তিন দিন কারাগারে থাকতে হলো। এ দায়ভার ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। আমাদের হয়রানি করা হয়েছে, সে জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, চল্লিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সুদসহ সমুুদয় টাকা পরিশোধ করেছি, এরপরও কারাগারে যেতে হয়েছে। এ জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা দায়ী। যদি ঋণ পরিশোধ না করে থাকি তবে কেন আমাদের বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়নি। উকিল নোটিশ পাঠালেই জানতে পারতাম ঋণ পরিশোধ হয়নি। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা না করে সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দিল। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মহির মন্ডল জানান, এলাকার ৩৭ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয় এবং ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার বিষয়ে কোনো কৃষক আগে জানত না। ঋণ পরিশোধের জন্য কৃষকদের নোটিশ দেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটির কাছেও কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পূর্বে নোটিশ দিয়েছেন এমন প্রমাণ ব্যাংক দেখাতে পারেননি। এ তদন্ত আইওয়াশ ছাড়া আর কিছু নয়।
এ প্রসঙ্গে তদন্ত দলের প্রধান বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও আইন) মো. আহসানুল গণি বলেন, মূলত গ্রুপ ঋণের কারণেই সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখানে ব্যাংকের কিছু করার ছিল না। তবে যাদের কম টাকা বকেয়া, তাদের বাদ দেওয়া যেত। এটা হয়তো ভুলবশত হয়েছে। পরবর্তীকালে বিষয়টি দেখা হবে। ১০ লাখ টাকা পরিশোধের পরও এত বকেয়া কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৫ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। কিছু কৃষক টাকা পরিশোধ না করায় চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বেড়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামের ৪০ কৃষক দলগত ঋণ হিসেবে ১৬ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে কেউ ২৫ হাজার, কেউ ৪০ হাজার টাকা করে ঋণ পান। ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ না করায় ২০২১ সালে ৩৭ কৃষকের নামে ব্যাংক মামলা করে। সম্প্রতি আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে গত ২৫ নভেম্বর ১২ কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর দেশজুড়ে সমালোচনায় ২৭ নভেম্বর পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক শামসুজ্জামান গ্রেপ্তার ১২ কৃষকসহ ৩৭ জনের জামিন মঞ্জুর করেন।