Home Third Lead মহাকাশের স্যাটেলাইটে তুরস্কে ভূমিকম্পের ফাটল

মহাকাশের স্যাটেলাইটে তুরস্কে ভূমিকম্পের ফাটল

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়ে গেল এখনই সেটির গভীর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করা অসংবেদনশীল কাজ বলে মনে হতে পারে। কারণ এই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ২২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, অগণিত মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছে। তাদের উদ্ধারের সময়-সুযোগ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।তারপরও বিজ্ঞান তো আর থেমে থাকে না। এবারের এই ঘটনা থেকে যেসব বিষয় জানা যাবে, ভবিষ্যতে তা হয়তো জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে।

ভূমিকম্পের পর যে বিপুল এনার্জি ছড়িয়ে পড়েছিল, তার ফলে কিভাবে সেখানকার ভূমি নড়াচড়া করেছে তার এযাবতকালের সবচেয়ে কাছাকাছি চিত্র ছবিতে দেয়া মানচিত্রটি। যে ডেটা ব্যবহার করে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে তা সংগ্রহ করা হয় শুক্রবার একেবারে রাতের প্রথম প্রহরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেন্টিনেল-ওয়ান-এ স্যাটেলাইট দিয়ে। স্যাটেলাইটটি তখন তুরস্কের সাতশো কিলোমিটার উপর দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছিল।

সেন্টিনেল স্যাটেলাইটে এমন একটি রাডার বহন করা হয়, যেটি দিয়ে যেকোনো আবহাওয়ায় মাটির স্পন্দন ধরা যায়। এই স্যাটেলাইট দিয়ে বিশ্বের ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলগুলোর ওপর নিয়মিত নজর রাখা হয়। বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের সামান্যতম পরিবর্তনও এটি দিয়ে ধরা যায়।

সোমবার যে পরিবর্তনগুলো ধরা পড়েছিল, সেগুলো মোটেই সূক্ষ্ম ছিল না। এগুলো ছিল বেশ নাটকীয়। ভূমিকম্পের ফলে ভূমি বেঁকে গেছে, ধসে পড়েছে, এমনকি কোথাও কোথাও ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। গবেষকরা ভূমিকম্পের আগের এবং পরের চিত্র তুলনা করেছেন নানা ধরণের কৌশল ব্যবহার করে। তবে ভূমিকম্পের কী ফল হয়েছে সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের সর্বশেষ ম্যাপ দেখে তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।

এই ছবির লাল রং দিয়ে বোঝানো হয়েছে স্যাটেলাইটটি যখন সর্বশেষ তুরস্কের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেখানকার ভূমি কিভাবে স্যাটেলাইটের দিক বরাবর সরছিল। আর নীল রং দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে ভূমি কিভাবে স্যাটেলাইটের উল্টো দিকে সরে যাচ্ছিল।

তুরস্কে সোমবার (৬ফেব্রুয়ারি) রাত একটা ১৭ মিনিটে (গ্রিনিচ মান সময়) ৭ দশমিক ৮ মাত্রার প্রথম যে ভূমিকম্প আঘাত হানে, এবং সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার যে দ্বিতীয় ভূমিকম্প- এই দুটির ক্ষেত্রেই ভূমি নড়েছিল বাম দিক বরাবর। এর মানে হচ্ছে, বিচ্যুতি রেখার যেদিকেই একজন থাকুক, অন্যদিকে সরে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রায় এক মিটার পর্যন্ত।

তবে যেটা হতবাক হওয়ার মতো, তা হল, এই ফাটল রেখা একদম মানববসতির ভেতর দিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় একেবারে ভবনের ভেতর দিয়ে।

সোমবার ঠিক কী ঘটেছিল, সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের এই ম্যাপ তা বুঝতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করবে। এই জ্ঞান তারা ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের বিভিন্ন মডেলে কাজে লাগাতে পারবেন। তুরস্কের কর্তৃপক্ষ তাদের পুনর্গঠন পরিকল্পনায় কীভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমানো যায়, সেক্ষেত্রেও এই জ্ঞান ব্যবহার করতে পারবেন।

এই ম্যাপটি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর অবজারভেশন এন্ড মডেলিং অব আর্থকুয়েকস, ভলকানোস এন্ড টেকটোনিকস। সংস্থার পরিচালক প্রফেসর টিম রাইট বলেছেন, এবারের ভূমিকম্পে কী প্রচণ্ড শক্তি কাজ করেছে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগ্রহ করা এসব তথ্য।

তিনি জানান, সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সব সময় ভূমিকম্পের ‘এপিসেন্টার’ দেখানো হয়, যেন এটার উৎস একটাই, বোমার মতো। কিন্তু আসলে সব ভূমিকম্পেরই সৃষ্টি হয় বিচ্যুতি-রেখা বরারব ঘষাঘষির কারণে। ভূমিকম্প যত বড় হয়, তত বেশি বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিচ্যুতি রেখা বরাবর ফাটল তৈরি হয়।

তিনি আরও জানান, আমরা এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভূমিতে এসব ফাটলের মানচিত্র তৈরি করতে পারি, কারণ সেখানকার মাটি সরে গেছে, এবারের ভূমিকম্পের ক্ষেত্র প্রায় ৫ মিটার হতে ৬ মিটার পর্যন্ত। এবার প্রথম ভূমিকম্পে ফাটল ছিল প্রায় তিনশো কিলোমিটার দীর্ঘ। আর দ্বিতীয় ভূমিকম্পে ফাটল ধরে আরও ১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে। যেসব এলাকা ফাটলের কাছাকাছি, সেখানেই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে ফাটল রেখার দুই পাশেই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এর প্রভাব পড়বে। এটা বেশ ভয়ংকর।

স্যাটেলাইটের আগের যুগে ভূতত্ত্ববিদরা ভূমিকম্পের মানচিত্র তৈরি করতেন ফাটল রেখা বরাবর হেঁটে। এটি ছিল বেশ কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া, যাতে অনেক খুঁটি-নাটি বাদ পড়ে যেত। ১৯৯০ এর দশকে মহাকাশ থেকে ব্যবহার করা যায় এমন রাডার ইন্টারফেরোমিট্রি প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি বেশ কার্যকর প্রযুক্তিতে পরিণত হয়েছে।

এর একটা কারণ, এখন পৃথিবীর কক্ষপথে অনেক বেশি উচ্চমানের সেন্সর লাগানো যন্ত্র আছে। এর পাশাপাশি শক্তিশালী কম্পিউটার আর অনেক বেশি স্মার্ট এলগরিদমও এক্ষেত্রে অবদান রাখছে। মাথার ওপর দিয়ে একটা স্যাটেলাইট চক্কর দিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এখন বিশেষজ্ঞদের কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করা তথ্য পৌঁছে দেয়া যায়। তবে সেন্টিনেল-ওয়ান-এ স্যাটেলাইটকে ভূমিকম্পের পর আবার তুরস্কের ওপর আসতে কয়েকদিন সময় লেগেছে। তবে আরও বেশি রাডার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

প্রফেসর রাইট বলেন, এই দশকের শেষ নাগাদ, আমরা সবচেয়ে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও একদিনের মধ্যেই এরকম বিশ্লেষণ করতে পারবো। তখন উদ্ধার কাজে এটি অনেক বেশি সহায়ক হবে। ভূমিকম্পের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই তল্লাশি এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানোটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তবে এই প্রযুক্তি এখনও পর্যন্ত ঐ সময়ের মধ্যে বিশ্লেষণটা হাজির করতে পারছে না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা