রূপাঞ্জন গোস্বামী
বৈচিত্রময় ভারতের উত্তর পূর্বে আছে দেশের অন্যতম সুন্দর রাজ্য মিজোরাম । ঘন সবুজ অরণ্য, সুউচ্চ পর্বতমালা, চপলমতি ঝর্না ও সফেন পাহাড়ি নদী বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা মিজোরাম, আজও অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। তাই হয়তো শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্যঠাসা, ২১০৮৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মোহময়ী মিজোরাম আজও অনাঘ্রাত ফুলের মতই সুন্দর।
মণিপুর, অসম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সীমান্ত দিয়ে ঘেরা মিজোরামে আছে প্রায় ২১ টি পর্বতমালা। এইসব পর্বতমালার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা উপত্যকাগুলিতে বাস করে ভারতের অন্যতম বিনয়ী উপজাতি ‘মিজো’।
নিতে আসবেন মিজো গাইড
মিজোরামের রাজধানী আইজলের লেঙ্গপুই বিমান বন্দরের বাইরে আসার পর, হাসি মুখে আপনার দিকে এগিয়ে আসবেন আপনার গাইড কাম ড্রাইভার। হাতে মিজোরামের ঐতিহ্যবাহী ‘রেড ভান্ডা’ ফুলের তোড়া। হাসিখুশি মিজো মানুষটিকে আপনি আগামী সাতদিন মিজোরাম ঘোরার সব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে গাইডের দুধ সাদা সেডান ছুটবে হোটেলের দিকে।
গাড়ি চালাতে চালাতে গাইড আপনাকে জানাবেন, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে সম্ভবত চিন থেকে মিজোরা প্রবেশ করেছিল ভারতীয় ভূখণ্ডে। তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান বাংলাদেশ থেকে শুরু করে মায়ানমারের ভূখণ্ড পর্যন্ত। তারপর আপনাকে নিরাপদে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেবেন গাইড, পরদিন সকালে আপনাকে নিতে আসার কথা জানিয়ে।
এরপর দিন ছ’য়েক ধরে সপ্রতিভ ও বিনয়ী গাইড আপনাকে দেখাবেন,মিজোরামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ফাউঙ্গপুই (৭০৭৬ ফুট), রেইক পিক (৫০৭৮ ফুট), লাওং নদী, মিজো পূর্বপুরুষদের গ্রাম ফালকাওন, মিজোরামের জনপ্রিয় পার্বত্য শহর মুইফাং, মিজোরামের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত ভেন্টওয়াং। দেখাবেন তুইরিহিয়ান জলপ্রপাত, মিজোরামের ধানের গোলা চামফাই উপত্যকা, ‘রি ডিল’ লেক, তামডিল লেক, ফাংগুই ন্যাশনাল পার্ক ও আরও অনেক অজানা পর্যটন কেন্দ্র।
সফরের শেষ দিনে থাকবে চমক
মিজোরামের সফর শেষ হওয়ার আগের দিন, আপনাকে নিতে এসে গাইড বলবেন, “স্যার আপনি কি জানেন, মিজো উপজাতি বিখ্যাত তার প্রবাদপ্রতিম সততার জন্য?” শুনে আপনি অবাক হবেন না। কারণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সফর করার সময়, বিভিন্ন মানুষের মুখে আপনি এই সততার কথা অনেক শুনেছেন। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই হয়েছে বিরূপ অভিজ্ঞতা।
অবশ্য আপনার অবাক না হওয়া দেখে, অবাক হবেন না গাইডও। হাসিমুখেই তিনি আপনাকে গাড়িতে বসতে বলবেন। আপনাকে নিয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি এগিয়ে চলবে রাজধানী আইজলের পূর্ব দিকে। পিচঢালা ঝাঁ চকচকে রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ধরবে পাহাড়ি রাস্তা। এগিয়ে চলবে ধীর গতিতে।
কারণ রাস্তা চওড়া হলেও হাল বেশ খারাপ। প্রায় গোটা রাস্তাতেই খুঁজে পাবেন না পিচের অস্তিত্ব। থাকলেও তা চাপা পড়ে গিয়েছে কাদামাটির নীচে। রাস্তার বাম দিকে পাথুরে ও কাদামাটির পাহাড়। ডান দিকে কোথাও ঘন অরণ্য, কোথাও সবুজ উপত্যকা। রাস্তার জায়গায় জায়গায় ধস নামার চিহ্ন।
গাড়ি করে ধুলো উড়িয়ে যাওয়ার সময়, মাঝে মধ্যে দেখা দেবে লাল টিনের ছাউনি দেওয়া কুয়াশা ঘেরা গ্রাম। দেখে মনে হবে প্রকৃতির কোলে গ্রামটি ঘুমিয়ে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
এটা কী হচ্ছে!
এভাবে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর, এগিয়ে আসবে ‘সেলিং’। ছোট্ট এই জনপদটিতে বাস করেন প্রায় হাজার খানেক মিজো। সেলিংয়ের পাইস হোটেলে ছাঙ্গবাং (চালের রুটি), ছুম হান (ভাপানো সবজি) ও চা দিয়ে প্রাতরাশ করে নেবেন আপনি ও আপনার গাইড।
প্রাতঃরাশের পর আবার ছুটবে আপনার গাড়ি। সেলিংকে পিছনে রেখে, বেহাল ৬ নং জাতীয় সড়ক পাড়ি দিয়েছে মণিপুরের দক্ষিণ পশ্চিমে থাকা পাহাড় ঘেরা টিপাইমুখের দিকে। সেই পথেই এগিয়ে যাবে আপনার গাড়ি। মাত্র আধ কিলোমিটার যাওয়ার পর আপনার নজর টেনে নেবে পথের দুদিকে থাকা অগুনতি দোকান।
চালাঘরের দোকানগুলির একটিতেও দোকানদার নেই। অথচ দোকানগুলিতে সাজানো আছে হরেকরকম পণ্য। এই দৃশ্য দেখার পর আপনার অনভ্যস্ত চোখ আপনার মনকে প্রশ্ন করবে, “এক সঙ্গে দোকানদারেরা গেল কোথায়! এভাবে কেউ দোকান খোলা রেখে যায়! তাও আবার বড় রাস্তার পাশে! এক্ষুণি সব চুরি হয়ে যাবে তো!”
হঠাৎ আপনার নজর যাবে বেশ কিছু মানুষের দিকে, যাঁরা দোকানগুলিতে সাজিয়ে রাখা পণ্য অম্লানবদনে তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরছেন। এমনকি রাস্তা দিয়ে ট্রাক নিয়ে যাওয়া অনেক ড্রাইভারও দোকানগুলির পাশে ট্রাক থামিয়ে পণ্য তুলে নিচ্ছেন।
আপনি নির্ঘাত মাথায় হাত দেবেন। কারণ সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে দোকানদারের। আপনি উত্তেজিত হয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করবেন,”এটা কী হচ্ছে! এখানে কী থানা পুলিশ কিছুই নেই! চোরেদের রাজত্ব দেখছি তো। আর আপনি সকালে বললেন সততার কথা। দিনের বেলায় সবার চোখের সামনে দোকান লুঠ হয়ে যাচ্ছে, দেখার কেউ নেই!”
কোনও কথা না বলে, সামান্য হেসে গাইড তাঁর গাড়ি থামিয়ে দেবেন একটি দোকানের সামনে। দোকানটির পিছন দিকে সবুজ পাহাড়, সামনে হালকা হয়ে যাওয়া অরণ্য। সেই অরণ্যের ফাঁকফোকর দিয়ে আপনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে দিগন্তবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র, খাল বিলের দল।
গাইডের গুগলি
চালাঘরের দোকানটির ডালায় রাখা আছে টাটকা সবজি, ফল, মাছ, ঝিনুক, কাঁকড়া। রাখা আছে ঘরে তৈরি ফলের রস ভর্তি বোতল, শুঁটকি মাছ, আচার, ডাল, চাল ও অনান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। কিন্তু দোকানদারের দেখা নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে আপনার গাইড ফলের রসের দুটো বোতল তুলে নেবেন।
তারপর একটা বোতল আপনাকে দিয়ে অন্য বোতলের মুখ খুলে ফলের রস খেতে শুরু করবেন। আপনি রেগে উঠে বলবেন,” এসব হচ্ছেটা কী! লজ্জা করছে না দোকানদারকে ঠকাতে। ছিঃ, আপনি সততার কথা বলেন কোন মুখে!”
একটুও রাগবেন না গাইড। বরং হেসে বলবেন, “নিশ্চিন্তে ফলের রস খান স্যার, কারণ আপনি এখন আছেন সততার রাজ্যে। এখানে না বলে দোকান থেকে জিনিসপত্র তুলে নেওয়াটাই নিয়ম।” আপনার চোখ উঠবে কপালে। কিছুই বুঝছেন না গাইডের হেঁয়ালি।
গাইড আপনার হাত থেকে ফলের রসের বোতলটা নিয়ে ছিপি খুলে দিয়ে বলবেন, “নিশ্চিন্তে খান স্যার, দোকানি ঠকবে না।” আপনি মনে মনে বলবেন,”আর ঠকবেনা বলে কী হবে। সে ব্যাটা কোথায় কে জানে। যা সর্বনাশ হওয়ার হয়েই তো গেল।”
আপনি তখনও ফলের রসে চুমুক দেবেন না। কিন্তু নির্বিকারচিত্তে বোতলটি শেষ করবেন গাইড। সেই দৃশ্য দেখে রাগে আপনার গা জ্বালা করবে।
হঠাৎই গাইড জিন্সের পকেট থেকে বের করবেন মানিব্যাগ। তারপর দোকানের ডালার পিছন দিকে রাখা প্লাস্টিকের বয়ামটি তুলে নেবেন। বড় মুখের বয়ামটি স্বচ্ছ। তাই বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে বয়ামের ভেতরে রাখা দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ ও একশো টাকার কয়েকটি নোট ও প্রচুর খুচরো পয়সা।
গাইড বয়ামের ঢাকনা খুলবেন। তারপর মানিব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে বয়ামের মধ্যে ফেলবেন এবং বয়ামের ভেতর থেকে একটি দশ টাকার নোট বের করে নেবেন।তারপর ধীরেসুস্থে বয়ামের মুখ বন্ধ করে আপনার হাত ধরে নিয়ে যাবেন ফলের রসের বোতলগুলির কাছে।
আপনি দেখবেন বোতলগুলির নীচে কাঠকয়লা দিয়ে ইংরেজিতে লেখা আছে Rs-20। গাইড আপনাকে বলবেন, “স্যার দুটো বোতল নিয়েছিলাম। চল্লিশ টাকা দাম হয়। পঞ্চাশ টাকা বয়ামে ফেলে দশ টাকা তুলে নিয়েছি। আমি কি চুরি করেছি স্যার? দোকানদারকে ঠকিয়েছি?” আপনার বলার কিছু থাকবে না। তাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন আপনি।
‘নগাহ লৌ ডাওর’
নিজেকে সামলে নিয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করবেন, “দোকানদার কোথায়? গাইড বলবেন, “কে জানে কোথায়। হয়ত ক্ষেতের ফসল তুলছে। নয়ত কাঠ কাটতে গেছে বা খাল বিলে নেমেছে মাছ ধরতে।”
আপনি আবার প্রশ্ন করবেন, “সে দোকানে আসবে না?” গাইড সিগারেট ধরিয়ে বলবেন,”বিকেলে আসবে, মালপত্র গুছিয়ে ঘরে নিয়ে যাবে।” ইতিমধ্যে আপনার কৌতুহল পৌঁছে যাবে চরমে। একটু রেগেই গাইডকে হয়ত বলবেন,”এবার একটু ঝেড়ে কাশুন তো মশাই, হেঁয়ালি করবেন না। অনেক হয়েছে।”
মিজো গাইডের মুখে তখনও থাকবে হাসি। গাইড আপনাকে বলবেন,”এই এলাকায় প্রায় হাজার বছর ধরে চলা এই প্রথাটির নাম ‘নগাহ লৌ ডাওর’ । মিজো ভাষায় বাক্যটির অর্থ ‘বিক্রেতাহীন দোকান। এলাকার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এই ‘নগাহ লৌ ডাওর’। জাতীয় সড়কে তো বটেই, গ্রামের রাস্তার পাশেও দাঁড়িয়ে আছে এরকম অজস্র দোকান, যেখানে দোকানদার নেই। আসলে স্যার এখানে ব্যবসার মূলধন হল, ক্রেতা ও বিক্রেতার পারস্পরিক বিশ্বাস।”
এরপর গাইডের কাছে থেকে আপনি জানবেন এমন কিছু কথা, যা সেলিংয়ে না এলে হয়তো আপনি কোনওদিন বিশ্বাসই করতেন না।” গাইড জানাবেন, দোকানদারেরা আসলে কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ। রোজ ভোরে সপরিবারে দোকানে এসে তাঁরা ডালা সাজিয়ে দেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করা কৃষিজ পণ্য দিয়ে।
পণ্যগুলির সাথেই তাঁরা দোকানে রেখে যান ঝরনা, নদী, খাল বিল থেকে ধরা মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক। রেখে যান জ্যান্ত মুরগি, ডিম, প্যাকেটবন্দি শুয়োরের মাংসও। প্রত্যেকটি পণ্যের নিচে পিস পিছু বা প্যাকেট পিছু দাম লেখা থাকে। আর আর রেখে যান বয়ামরূপী ক্যাশবাক্স ‘পাউইসা বাউম’।
দোকানে পসরা সাজিয়ে রেখে দোকানদার তাঁর পরিবার নিয়ে চলে যান জমিতে। কেউ চলে যান ঝর্না, খাল বিল বা নদীতে মাছ ধরতে। কেউ চলে যান জঙ্গলে। কাঠ, ফল, মধু, মাশরুম সংগ্রহ করার জন্য।
সন্ধ্যা হওয়ার আগেই দোকানদার আবার সপরিবারে ফিরে আসেন দোকানে। অবিক্রিত পণ্য ও ‘পাউইসা বাউম’ নিয়ে ফিরে যান গ্রামের বাড়িতে। তারপর ‘পাউইসা বাউম’ খুলে লভ্যাংশের টাকাটা তুলে নিয়ে, বাকি টাকাটা আবার রেখে দেন বয়ামে।
দোকান থেকে ফিরে আসা অবিক্রিত পণ্যগুলি রাঁধা হয়ে যায় দোকানদারের হেঁশেলেই। পরের দিন ভোরে কৃষক পরিবার আবার টাটকা পণ্য দিয়ে সাজিয়ে তোলেন তাঁদের দোকান। বিক্রেতার দেখা ক্রেতারা ছ’মাসে একবারও পান কিনা সন্দেহ। কিন্তু এভাবেই চলছে পণ্য ও অর্থের বিনিময়। শত শত বছর ধরে। এই ভারতেই।
এ পর্যন্ত জানার পর আপনি প্রশ্ন করবেন,”আসার সময় রাস্তায় দেখলাম ট্রাক চালকেরাও দোকান থেকে জিনিসপত্র তুলে নিচ্ছে। ওরা কি আদৌ পয়সা দেবে?” গাইড গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলবেন,”দেবে স্যার দেবে। বাকিটা জানার জন্য বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। লাঞ্চ সেরে আসি। তারপর আপনাকে নিয়ে বিকেলে আবার ফিরে আসব। এই দোকানেই।”
আপনাকে নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করবে গাড়ি। কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকা একটি পাইস হোটেলের সামনে গিয়ে গাড়ি থামাবেন গাইড। মিজোরামের অন্যতম বিখ্যাত ডিস ভাওকসার স্বাদ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করবেন।
আপনি দুটো ডিশের অর্ডার দেবেন। লাল করে ভাজা শুয়োরের মাংস, অয়েস্টার মাশরুম, কচি পালং শাক, রসুন, আদা, কাঁচা লঙ্কা, গোলমরিচ দিয়ে রাঁধা হয় এই ‘ভাওকসা’। স্বাদ অসাধারণ। তবে খাওয়ার নিয়ম আঠালো ভাত দিয়ে।
ভাঙ্গবে অবিশ্বাসের প্রাচীর, জ্বলে উঠবে বিশ্বাসের প্রদীপ
দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর আপনার গাড়ি আবার এগিয়ে চলবে বিক্রেতাহীন দোকানগুলির দিকে। বিকেলের সোনালি সূর্যের আলোয় ভাসতে থাকা সেলিং উপত্যকাকে ঘিরে ফেলতে থাকবে হিংসুটে কুয়াশা।
তারই মধ্যে আপনার চোখে পড়বে, মাঠের দিক থেকে রাস্তার দিকে দলবেঁধে এগিয়ে আসছেন কিছু মিজো নারী ও পুরুষ। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবলে আপনার মন পড়ে ফেলবেন গাইড। রাস্তায় চোখ রেখে আপনার দিকে না তাকিয়েই বলবেন, “স্যার, এরাই হল দোকানদার। দিনের ব্যবসার লাভ লোকসান বুঝে নিতে আসছে।”
মাঠ পেরিয়ে আসা কর্দমাক্ত নারী পুরুষেরা একে একে ঢুকে পড়বেন নিজেদের দোকানে। সপরিবারে বস্তায় ভরতে থাকবেন অবিক্রিত পণ্যগুলি। পরিবারের একজন হাতে তুলে নেবেন ‘পাউইসা বাউম’। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দোকান ফাঁকা করে পসারীরা হারিয়ে যাবেন মাঠের বুকে জমতে থাকা কুয়াশার অন্তরালে।
আপনার গাড়ি গিয়ে থামবে সেই দোকানের সামনে। যেখানে আপনি ফলের রস খেয়েছিলেন। গিয়ে দেখবেন, দ্রুত হাতে অবিক্রিত পণ্যগুলিকে বস্তাবন্দি করছেন হয়ত কোনও প্রৌঢ় কৃষক ও তাঁর পরিবার।
গাইড সেই প্রৌঢ় কৃষকের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবেন। প্রৌঢ় মিজোর মুখ আধো অন্ধকারেও ঝলমল করে উঠবে ‘নগাহ লৌ ডাওর’ প্রথাটির কথা আপনার মত বহিরাগতকে বলার সময়। মানুষটি আপনাকে জানাবেন, প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয় তাঁদের।
সারা দিন কাটে চাষের জমি, জঙ্গল ও খাল বিলে। তাঁদের কাছে দিনের প্রতিটি ঘণ্টাই দামী। তার থেকেও দামী হল দুটি হাত। পরিবারের কোনও সদস্যকে দোকানে বসানোর অর্থ, দুটি হাত থেকে হওয়া উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাই এই এলাকায় আসা মিজোদের পূর্বপুরুষেরা বহু শতাব্দী আগে শুরু করেছিলেন ‘নগাহ লৌ ডাওর’ প্রথা।
প্রৌঢ় কৃষক আপনাকে জানাবেন, পুরো মিজো সমাজ দাঁড়িয়ে আছে ‘লাওমগাইনা’ নীতিশাস্ত্রের ওপর। শৈশব থেকেই প্রতিটি মিজো শিশুকে শেখানো হয়, মিজো সমাজে থাকতে গেলে হতে হবে বিনয়ী, সাহসী, দয়ালু, পরোপকারী ও অতিথিবৎসল। সর্বদা চলতে হবে সত্যের পথে। ব্যক্তিস্বার্থের থেকেও বেশি প্রাধান্য দিতে হবে জাতিস্বার্থকে। তাই মিজোদের জীবনের সেরা সঙ্গীর নাম ‘বিশ্বাস’।
প্রৌঢ় কৃষক মুক্তকণ্ঠে আপনাকে জানাবেন,”আজ পর্যন্ত আমরা ঠকিনি। আমাদের দোকান থেকে কোনওদিন কোনও পণ্য চুরি যায়নি। জিনিস নিয়ে দাম না দিয়ে চলে যাননি কোনও ক্রেতা। আজও তাই আমাদের বিশ্বাসের প্রাচীরে এতটুকুও আঁচড় পড়েনি।”এরপর আপনার থেকে বিদায় নিয়ে, বস্তা কাঁধে প্রৌঢ় কৃষক সপরিবারে হারিয়ে যাবেন মেঠো বা অরণ্যপথে।
আপনাকে ঘিরে বাড়তে থাকবে কুয়াশার দাপট। জ্বলে উঠবে গাইডের গাড়ির হেড লাইট। আপনাকে নিয়ে গাড়ি ছুটবে আইজলের দিকে। আপনার চোখের কোণে হয়ত জমে উঠবে এক ফোঁটা জল।