Home Third Lead ‍মিজোরামে শরণার্থীর ঢল

‍মিজোরামে শরণার্থীর ঢল

সীমান্তের এই টিয়াউ নদী পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে শরণার্থীরা; (ইনসেটে) একটি ক্যাম্পে রান্না করছেন শরণার্থী নারীরা : বিবিসি

মিয়ানমার ছেড়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থীর ঢল নেমেছে। সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আতঙ্কিত লোকজন গোপনে চলে যাচ্ছেন মিজোরামে। এরই মধ্যে হাজার হাজার বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। মিয়ানমারে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশটিতে আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু হলে তা কঠোর হস্তে দমন করা হয়। আঞ্চলিক বিদ্রোহী ও গোপনে আন্দোলনরত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করে সেনাবাহিনী।

গত কয়েক মাস ধরে এমন অভিযানে বিদ্রোহীদের উচ্ছেদকালে ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দিচ্ছে মিয়ানমার সেনারা। প্রাণ বাঁচাতে গ্রামবাসী পালিয়ে যাচ্ছে মিজোরাম সীমান্তে। তারা টিয়াউ নদী পেরিয়ে ঢুকে যাচ্ছে রাজ্যটিতে। মিজোরামের সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি রাজ্য কর্তৃপক্ষও তাদের সাদরে গ্রহণ করছে। সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মিজোরামে গত এক বছরে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী ৩১ হাজার ৩১৬ জন। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো বেশি বলেই ধারণা বিভিন্ন এনজিও ও সহায়তা সংস্থার।

মিজোরামে আশ্রয় নেয়া এসব শরণার্থীর বেশির ভাগই মিয়ানমারের চিন রাজ্যের। তাদের মধ্যে মিয়ানমারের অন্তত ১৪ জন সাবেক এমপি রয়েছেন। মিজোরামের সীমান্তে চাম্পাই হিলস এলাকায় জোখাওথর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন চিন রাজ্যের বাসিন্দা মোয়েত অ্যালো শোয়ে সিন। তিনি একটি প্রাইমারি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। মাস পাঁচেক আগে সেনাবাহিনী তার বাবাসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেলে, তিনি কোনোরকম পালিয়ে বেঁচে যান এবং মিজোরামে চলে আসতে বাধ্য হন।

তিনি বলেন, পরিবারের অন্যদের ফেলে চলে আসাটা সহজ ছিল না মোটেই। ঘন জঙ্গল আর পাহাড় পেরিয়ে দশ দিন লেগেছে এখানে পৌঁছতে। পথে কোথাও সংঘর্ষ, তখন গাঢাকা দেয়া, আবার পথ চলা- এভাবেই আমি কোনোরকমে সীমান্ত পেরিয়েছি। মিজোরাম কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার ভিনদেশীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেন, মিয়ানমারের চিন রাজ্যের মানুষের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। ঐতিহাসিক কারণে হয়তো সীমান্ত বিভেদ হয়েছে, কিন্তু মিজো আর চিনরা একই জাতিগোষ্ঠীর। তিনি বলেন, যেমন আমার মা ও খালার জন্ম হয়েছে মিজোরামে। কিন্তু আমার দুই মামার জন্ম মিয়ানমারের চিনে। তারা সেখানেই রয়ে গেছেন। তাদের বংশধররাও আছে। কাজেই আমরা একই পরিবার, শুধু সীমান্তের দু’দিকে পড়ে গেছি। তিনি বলেন, পরিবারের কিছু সদস্য ওদিকে বিপদে পড়েছে, আমাদেরই তো সাহায্য করতেই হবে।

মিয়ানমারের সাথে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলতে একটা পাহাড়ি নদী, টিয়াউ। এখন ভরা বর্ষায় জলে টইটম্বুর, তবে বছরের অন্য সময় হেঁটেই পেরোনো যায় এই ছোট্ট তিরতিরে জলধারাটি। দু’দেশের মধ্যে এখানে সীমান্ত স্বাভাবিক অবস্থায় একেবারেই শিথিল। দু’পারের মানুষের মধ্যে এমনিতে যাতায়াতও বেশ অবাধ- মিয়ানমারের সফট ড্রিঙ্ক বা বিয়ার খুব সহজেই মেলে ভারতের দিকে বাজারে। এমনকি মিয়ানমারে তৈরি মোটরবাইকও সীমান্তের অন্য পাড়ে খুব জনপ্রিয়।

কিন্তু গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সীমান্তে রীতিমতো কড়াকড়ি চলছে বর্ডার চেকপোস্ট পেরিয়ে দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত কাগজে-কলমে অন্তত বন্ধই বলা চলে। তবে তার পরেও হাজারে হাজারে মিয়ানমারের নাগরিক ভারতে ঢুকেই চলেছেন।
ভারত সরকার তাদের শরণার্থীর মর্যাদা না দিলেও মিজোরামের রাজ্য সরকার ও স্থানীয় মানুষজন তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে মিজোরামের প্রশাসন, বিভিন্ন এনজিও ও চার্চের সক্রিয় উদ্যোগে রাজ্যজুড়ে তাদের জন্য বহু আশ্রয় শিবির চালু করা হয়েছে।

চিন স্টেটে অন্তত দু’টি বিদ্রোহী গোষ্ঠী- চিন ডিফেন্স ফোর্স ও চিন ন্যাশনাল আর্মি সে দেশের সেনা ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছে বহু দিন ধরেই।

গত বছর থেকে সে দেশের গণতন্ত্রকামীরাও আর্মির বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেই সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন ও নির্যাতন।
জম্মু, হায়দ্রাবাদ বা দিল্লিতে এই রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয়দের যে ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব চোখে পড়ে, মিজোরামে এই চিন স্টেটের শরণার্থীদের প্রতি কিন্তু সেই ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। রাজ্যের শাসক দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক এমপি ভ্যান লালজাওমাও বলছিলেন, ‘মিজোরাম এদের আশ্রয় দিয়েছে, কারণ আমরা একই ক্ল্যানের, মিজো আর চিন-রা একই এথনিসিটির।’

মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলছিলেন, ‘নিজেদের লোক বলেই শুধু নয়, মানবিক কারণেই মিজোরাম এদের পুশ ব্যাক করতে পারবে না। এমনকি, আমি তো বলব রোহিঙ্গাদেরও ভারতের ফেরানো উচিৎ নয়।’

খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত মিজোরামে চার্চের সংগঠন খুবই শক্তিশালী, তারা এই শরণার্থীদের মুখে খাবার তুলে দিতে খুব সাহায্য করছে। স্যালভেশন আর্মি বা মেডস্যঁ স্য ফ্রন্টিয়ারের মতো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও শিবিরগুলোতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

আইজলের চানমারি চার্চে প্রার্থনা গানের মহড়া দিতে ব্যস্ত কিশোর-কিশোরীরাও একসুরে বলছিল এই শরণার্থীরা মিজোরামে সব সময় স্বাগত, তাদের জন্য মিজোদের সব সময় সহানুভূতি থাকবে। চার্চ কয়্যারের লিড সিঙ্গার ডেভিড তো সোজাসুজিই বলেন, ‘জেনে রাখুন মিজোরা কখনো তাদের খাওয়াতে দ্বিধা করবে না- দেড় বছর হয়ে গেছে, দরকার হলে যত দিন দরকার হবে তত দিনই তাদের মুখে আমরা খাবার তুলে দেবো।’
মিজোরামের বৃহত্তম এনজিও ইয়ং মিজো অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমএ এই শিবিরগুলো চালাতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে, হাজার হাজার মানুষের জন্য এতগুলো শিবির চালাতে যে বিপুল লোকবল দরকার তার বেশিটাই জোগাচ্ছে এই সংগঠনের কর্মীরা। কিন্তু কত দিন এটা টানা যাবে, সেটা তাদেরও বেশ দুশ্চিন্তায় রেখেছে। চাম্পাই জেলায় ওই এনজিওর প্রধান সংগঠক লালছুয়ানোমা বলেন, ‘আমাদের কাছে শরণার্থীদের সাহায্য করার মতো নিজস্ব কোনো অর্থ নেই, আমরা পুরোপুরি মানুষের দানের ওপর নির্ভর করে চলছি।’
‘আর মিজোরা অর্থ দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে, খাবার দিয়ে যেভাবে সাহায্য করছেন তা ভাবাই যায় না- তারা দিচ্ছেন বলেই এতদিন এই শিবিরগুলো চলতে পারছে। কিন্তু আমরা সত্যিই জানি না সামনে কী হবে!’, বেশ অনিশ্চয়তার সুর শোনা যায় তার গলায়। আর একটা বড় সমস্যা হলো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মিয়ানমারের এই নাগরিকদের শরণার্থী বলেই স্বীকৃতি দিচ্ছে না, ফলে পুরো দায়িত্বটা এসে পড়েছে মিজোরামের কাঁধে।
‘আমি তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে একাধিকবার বলেছি এই মানুষগুলোকে আমাদের মানবিক সাহায্য করা দরকার। যখনই দিল্লির কোনো ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সাথে আমার দেখা হচ্ছে তাদেরও একই কথা বলছি’, বলেন মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা। তিনি অবশ্য এটাও মানেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের এই নাগরিকদের শরণার্থীর মর্যাদা দিতে ভারত সরকারের কিছু সমস্যা বা বাধ্যবাধকতা আছে।
‘কিন্তু তাই বলে আমরা তাদের মাথার ওপর একটু ছাদ কিংবা মুখে একটু খাবার কেন তুলে দিতে পারব না?’
‘এটুকু মানবিক আচরণ তো যেকোনো সভ্যতার কাছেই প্রত্যাশিত। আমরা জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সনদে সই করি বা না করি, এটুকু তো করতেই পারি তাই না?’, দিল্লির ভূমিকাকে ঈষৎ কটাক্ষ করেই মন্তব্য করেন জোরামথাঙ্গা। তবু ঘটনা হলো, এই তিরিশ-বত্রিশ হাজার শরণার্থীর জন্য ভারত সরকার আজ পর্যন্ত একটি পয়সাও খরচ করেনি। শরণার্থী শিবিরগুলোর আশপাশে জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তাদেরও ঘেঁষতে অনুমতি দেয়া হয়নি। ফলে এই সব ক্যাম্পের বাসিন্দারা ভারত সরকার বা জাতিসঙ্ঘের কাছ থেকে বা শরণার্থী হিসেবে আজ পর্যন্ত কোনো পরিচয়পত্র পাননি।

মিজোরাম সরকার শুধু তাদের একটি সাময়িক পরিচয়পত্র দিয়েছে, যাতে অবশ্য কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধার গ্যারান্টি নেই। তাতে শুধু নাম আর ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অমুক নাগরিক অস্থায়ীভাবে মিজোরামে বসবাস করছেন।

আইজল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জে ডাউঙ্গেল বিবিসিকে বলছিলেন, এই মানুষগুলোকে শরণার্থীর স্বীকৃতি দিতে দিল্লির আসলে ‘প্রবল কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসুবিধা’ আছে।

তার কথায়, ‘ভারত এতদিনে উপলব্ধি করেছে যে মিয়ানমারকে বয়কট করে কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে তাদের কোনো লাভ হবে না।’

‘উল্টো মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট বা কালাদান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো যেসব প্রকল্পে ভারতের শত শত কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সেগুলো আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’
‘ওদিকে চীন যেহেতু মিয়ানমারের রাখাইন পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে… ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্রই থাক বা সামরিক শাসন, নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারতের কিছুতেই মিয়ানমারকে চটানো চলবে না’, মন্তব্য করেন জে ডাউঙ্গেল।
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আসা অনেকেই যেমন রাখাইনে ফেরার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, চিন স্টেটের এই বাসিন্দারা কিন্তু এখনই হাল ছাড়তে রাজি নন বরং তারা দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখেন রোজই।
মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা যেমন মনে করেন, উর্বর ও সম্পদশালী মিয়ানমার ছেড়ে এই শরণার্থীরা পাকাপাকিভাবে মিজোরামে থেকে যেতে চাইবেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণই নেই। তার কথায়, ‘ওখানকার ঘাস অনেক বেশি সবুজ। বার্মায় ক্ষেত উপচে ধান হয়, মাটি খুঁড়লে কখনো স্বর্ণ, কখনো বা মূল্যবান মণিরতœ পর্যন্ত পাওয়া যায়। ওখানে তাদের অনেক জমি-বাড়ি-সম্পত্তিও পড়ে আছে।’ ‘চিন স্টেটের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আমি দেখেছি একটু পর পর ঢিবির মতো কী সব খোঁড়া। জিজ্ঞেস করে জানলাম, গ্রামবাসীরা নাকি ওই ঢিবি খুঁড়ে পেট্রোলিয়াম তোলেন। তো সেই সোনার দেশ ছেড়ে কেন তারা আসতে বাধ্য হচ্ছেন সেটাই একবার ভাবুন’, বলছিলেন তিনি।

জোরামথাঙ্গার দৃঢ় বিশ্বাস, মিয়ানমারের পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হলে বা সেনা অভিযানে একটু ঢিলে পড়লেই এই শরণার্থীরা অনেকেই দেশের পথে পা বাড়াবেন। তবে কবে সেটা ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে তারও কোনো আন্দাজ নেই।

– বিবিসি ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।