হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বহরা ইউনিয়নের দেওগাঁ একটি প্রাচীন গ্রাম। কাশিমনগরের পার্শ্ববর্তী এ গ্রামটিতে নির্মিত প্রাচীন মসজিদ খুব একটা বিশাল না হলেও মোগল আমলের স্থাপনা বিধায় এর একটা বিশেষত্ব আছে এলাকা বাসীর দাবি । পূর্বে সংশ্লিষ্ট এলাকাটি ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পাঠানদের অধীনে থাকাকালীন তাদের দ্বারা মাঝে মধ্যেই ত্রিপুরা আক্রান্ত হতো। তেমনি এক যুদ্ধে পাঠান বাহিনীর কাশিম খাঁ ও দাউদ খাঁ নামক দুই সেনাপতি বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শনপূর্বক এ অঞ্চলের বিজয় নিশ্চিত করেন।
সেনাপতিদ্বয় এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক শোভা ও ভূমির উর্বরতা দৃষ্টে বিমোহিত হয়ে সেখানে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করলে সম্রাট তাদেরকে পুরস্কার স্বরূপ সেখানে কিছু ভূমি দান করেন। তন্মধ্যে কাসিম খাঁ দিনাদহ নামক এলাকা প্রাপ্ত হন। দিনাদহ তখন থেকে কাসিম খাঁর নামানুসারে কাশিম নগর হিসেবে খ্যাত হয়। পরবর্তীতে পাঁচ মাইল দীর্ঘ এলাকা নিয়ে কাশিম নগর পরগণা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দিনাদহেরই একাংশ ছিল দেওগাঁ। কাশিম খাঁর বসতি স্থাপনের পর থেকে এখানে আস্তে আস্তে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জানা যায় এই মসজিদটি ইট সুরকি নির্মিত ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি দ্বিতল ভবন। এর আয়তন উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ ৩৭ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থ ৩৩ ফুট। দুই ভাগে বিভক্ত ভবনের পশ্চিমাংশ অর্থাৎ মূল ভবন দ্বিতল বিশিষ্ট। প্রস্থ ১৬ ফুট ৬ উঞ্চি করে দুই অংশের অভ্যন্তর ভাগ ৪ ফুট প্রস্থের দেয়াল দ্বারা বিভক্ত। পশ্চিমাংশের মূল ভবন তিনটি কক্ষে বিভক্ত। তন্মধ্যে মধ্যের কক্ষের অভ্যন্তর ভাগ বর্গাকার ১০ ফুট আয়তন বিশিষ্ট। উভয় পাশের কক্ষ প্রতিটির আয়তন ১০ ফুট x ৮ফুট ৬ইঞ্চি পরিমান। কক্ষ তিনটির প্রতিটির সামনে ও পেছনে (পূর্ব ও পশ্চিম পাশে) একটি করে দরজা রয়েছে।
মসজিদটি দীর্ঘদিন যাবৎ পরিত্যক্ত ছিল। বর্তমানে উপর তলা ব্যবহারযোগ্য করা হলেও নীচ তলা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নীচ তলার কিছুটা অংশ মাটির নীচে রয়েছে। প্রতিবেশিদের কেউ কেউ এটি দেবে গেছে বললেও অনুমিত হয় যে যুগ পরম্পরায় সংশ্লিষ্ট এলাকা ক্রমশ উঁচু হওয়ায় অব্যবহৃত মসজিদটি কিছুটা তলিয়ে গেছে। এতে ব্যবহৃত ইটের সাইজ ১০ ইঞ্চি x ৫ ইঞ্চি x ১ ইঞ্চি। মসজিদের মূল অংশ (পশ্চিমাংশ) চার কোনার চারটি গোলাকার পিলার; তিনটি কক্ষের প্রশস্ত দেয়াল এবং উপর দ্বিতীয় তলা তদুপরি তিনটি গম্বুজ স্থাপিত। এ অংশে উত্তর-দক্ষিণ দুই পাশে দুটি করে জানালা রয়েছে।
মুল ভবনের সামনের দেয়াল ৪ ফুট প্রস্থ এবং বাকি দেয়ালগুলো অড়াই ফুট প্রস্থ। সামনের অংশের অভ্যন্তর ভাগের আয়তন ১৩ ফুট x ৩০ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর সম্মুখ ভাগে তিনটি দরজা, উত্তরে এবং দক্ষিণে তুলনামূলক উঁচুতে একটি করে জানালা বিদ্যমান। এ অংশের ছাদটি মূল অংশের সামনের বারান্দা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে তাতে পার্শ্ব দেয়ালসহ টিনের চাল দিয়ে মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর দক্ষিণ পাশে দুতলায় উঠার সিড়ি রয়েছে।
মসজিদের দরজা সমূহ ছাড়াও নানা স্থানের পলেস্তারায় দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ছিল এমন প্রমাণ রয়েছে। সম্ভবত বার বার সংস্কারের কারণে তা নষ্ট হয়ে গেছে। দুতলার তিনটি দরজায় এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। মধ্যের দরজার উপরে একটি শিলালিপি রয়েছে। তাতে ফারসি ভাষায় লিখিত বয়ানে প্রতিষ্ঠাকাল, প্রতিষ্ঠাতা ও সংস্কারের সময়কাল লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্থানীয় অশীতিপর বৃদ্ধ কাজী জাহেদুর রহমানের দাবি অনুযায়ী এটি প্রথম সংস্কার করা হয় ১২৩৫ হিজরি (১৮২০ খ্রি.)। এতে লেখা রয়েছে : ‘সুদি মসজিদ বাদৌরে শাহে আকবর বরায়ে সেজদায়ে জাহেদ ওয়া মোমিন । বুদবানি শেখ মোহাম্মদ মহসীন;। তিনি এর ভাবার্থ করেন, ‘এই মসজিদ সম্রাট আকবরের আমলের মোমিন এবং সংসার বিরাগীদে সেজদার জন্য। ইহার প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোহাম্মদ মহসীন।’
ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ী সম্রাট আকবরের শাসনকাল ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে। যদি সম্রাট আকবরের শাসনামলে স্থাপিত হয়ে থাকে তাহলে এটি অন্তত পাঁচ শতাধিক বছর পূর্বের একটি স্থাপত্য নিদর্শন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই শিলালিপি অনুযায়ী এর সংস্কারও অন্তত দুই শতাধিক বছর পূর্বে হয়েছিল। এটি একাধিকবার সংস্কার হয়েছে তার আলামতও রয়েছে। সংস্কারের সময়ে প্রদত্ত পলেস্তারার কারণে ইটের সাইজ যেমন দেখা যায় না তেমনি এর অলঙ্করণও বিনষ্ট হয়েছে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, সামনের অংশের ছাদটি ছিল কাঠের ভিমের উপরে চুন-সুরকির দ্বারা স্থাপিত। কোনো এক সময়ে ভূমিকম্পের কারণে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই থেকে মসজিদটি পরিত্যাক্ত হয়।
বিগত ১৫/২০ বছর পূর্বে জনৈক হৃদয়বান ঠিকাদার এই অংশ আরসিসি ভিম দ্বারা ছাদ ও দরজার পাক্কা চৌকাঠ পূনঃসংস্কার করেন।
শিলালিপিতে বলা হয়েছে, সম্রাট আকবরের আমলের মোমিন ও সংসার বিরাগীদের সেজদার জন্য এটি নির্মিত। এতে অনুমিত হয়, এ এলাকায় সে সময়ে সংসার বিরাগী পথিকদের আনাগোণা ছিল। মসজিদের নীচ তলার পরিবেশ তথা পশ্চিমাংশের তিনটি কক্ষেই মেহরাবের পরিবর্তে দরজার অবস্থিতি প্রমাণ করে যে, সে স্থান মসজিদের নামাজের জন্য উপযুক্ত নয়। সংশ্লিষ্ট অংশের উপর তলার আকৃতিতে দেখা যায় তাতে নীচতলার মতো পৃথক তিনটি প্রকোষ্ঠের পরিবর্তে সম্পূর্ণ অংশ মিলিয়ে একটি কক্ষ এবং পশ্চিমাংশে কোনো দরজার পরিবর্তে মধ্যাংশে মেহরাব বিদ্যমান। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে জানালা রয়েছে। পূর্বদিকে অবস্থিত বারান্দার ছাদ তিনটি দরজার মাধ্যমে সমজিদের সাথে যুক্ত। এই বারান্দা থেকে দক্ষিণ দিকে নীচে নামার সিড়ি যুক্ত হয়েছে।
-একাত্তর পোস্ট