রবি গানে বদল
গানের বাণীতে আছে বাঙালি৷ রাজ্য সংগীতে সেটা হল বাংলা৷ মঙ্গলবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে গাওয়া হয়
গান গাইবার আগে দর্শকদের উঠে দাঁড়াতে বলা হয়৷ তারপর যে গান বিশিষ্ট শিল্পীরা পরিবেশন করেন, তা সুরে-কথায় একেবারে সেই চেনা রবীন্দ্রসংগীত৷ কিন্তু বদল শুধু শেষ স্তবকে৷
মূল গানে থাকা ‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা’ এবং ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ অংশটিকে ‘বাংলার পণ, বাংলার আশা’, ‘বাংলার প্রাণ, বাংলার মন’ করে গাওয়া হয়েছে বলে রেকর্ডিংয়ে শোনা যাচ্ছে৷ এই পরিবর্তন উৎসবের জমাটি আবহে সেভাবে নজর কাড়েনি৷ পরে তা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা৷
গানটির পরিবেশনায় ছিলেন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং গায়ক ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী, ইমন চক্রবর্তী, মনোময় ভট্টাচার্য, অদিতি মুন্সীরা৷ মঞ্চে তখন উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে৷
বদলের প্রস্তাব
কয়েকমাস আগে এ ধরনের পরিবর্তনের একটি প্রস্তাব শোনা গেছে৷বদল করা যায় কি না, সেটা জানতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তবে বিভিন্ন স্তরে এই নিয়ে আপত্তি থাকায় পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়৷ রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয়, গানটির শব্দে পরিবর্তন আনা হবে না৷
৭ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় রাজ্য সংগীত সংক্রান্ত বিল পাশ হয়৷ গত সোমবার বিধানসভা মিউজিয়ামে উদ্বোধনের সময় এই গান গাওয়া হয়েছিল৷ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে এই গান পরিবেশিত হওয়ার পর তা নিয়ে চলছে সমালোচনা৷
মুখ্যমন্ত্রী বলার পরও কীভাবে পরিবর্তিত গানকে রাজ্য সংগীত হিসেবে গাওয়া হল, তা নিয়ে বিস্ময় ও প্রশ্ন জেগেছে৷ গানের শিল্পীরা এ ব্যাপারে স্পষ্ট উত্তর দেননি৷ কেউ বলেছেন কী গেয়েছেন মনে নেই! আবার কারো বক্তব্য, কাগজে যা লেখা ছিল, তাই গেয়েছেন!
কঠোর প্রতিক্রিয়া
ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলার সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা৷ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘এটা অপকর্ম৷ ক্ষমতার অপব্যবহার যে-ই করেছে, তাদের আমি তীব্র ধিক্কার জানাই৷ ইতিহাস নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না৷ এই গানে রবীন্দ্রনাথ কথা লিখেছেন, সুর দিয়েছেন৷ এটা বদল করা যায় না৷”
ডয়চে ভেলেকে বিশ্বভারতীর আশ্রমিক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রবি ঠাকুর গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা পছন্দ করতেন না৷ সেটা তিনি নিজেই বলেছেন৷ তার পরও এই পরিবর্তন কাম্য নয়৷”
শিল্পী ও গবেষক শুভেন্দু মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলে গাওয়া এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ঔদ্ধত্য৷ সকলের প্রতিবাদ করা উচিত৷ যে শিল্পীরা এই গান গাইলেন, তারা কেন প্রতিবাদ করলেন না? তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত৷ দেড়শো বছর ধরে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গান শুনছেন, গাইছেন৷ ভোটে জিতেছি বলে সেটা পাল্টে দিতে পারি না৷”
প্যারোডি পরম্পরা
অবশ্য পাল্টা যুক্তিও রয়েছে৷ কেউ কেউ বলছেন, কিন্তু প্যারোডি তৈরি ও বাণীর ইচ্ছেমতো পরিবর্তন কি এক?
সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই পরিবর্তনকে আমি সমর্থন করি না৷ রবীন্দ্রনাথের গান নজরুল ও দ্বিজেন্দ্রলাল পরিবর্তন করে প্যারোডি করেছিলেন৷ কিন্তু সেটা প্যারোডিই ছিল৷ তার মাধ্যমে কখনো বার্তা দেওয়া হত, কখনো বা নিছক ব্যঙ্গ বা হাস্যরস তৈরির চেষ্টা থাকত৷ রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ বদলে দিলে সেটা রবীন্দ্রসংগীত থাকে না৷ তা হলে রাজ্য সংগীতের জন্য নিজেদের গান তৈরি করতে হতো৷”
রবীন্দ্র থেকে নজরুল
সম্প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের গানে পরিবর্তন করায় সমালোচনার মুখে পড়েন বিখ্যাত ভারতীয় সুরকার এ আর রহমান৷ একটি ছবিতে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি ভিন্ন সুর সংযোজনায় ব্যবহার করা হয়৷ তীব্র প্রতিবাদ জানান শিল্পীদের একাংশ৷ পরে ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছে ছবির নির্মাতারা৷
কবিগুরুর সৃষ্টি আর এখন স্বত্বের অধীন নয়৷ তা বলে তার যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যেই৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক অধ্যাপক রুমা মিত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে কোনো গান তার গীতিকার বা সুরকারের সম্পদ৷ সৃষ্টিকে বিকৃত করার অধিকার কারো নেই৷ এটা অনধিকার চর্চা৷ স্রষ্টা কী ভেবে গানে ওই কথা লিখেছেন, সেটা যারা পরিবর্তন করছেন, তারা কি জানেন? পরিবর্তন করার ফলে কি খুব ভালো জিনিস তৈরি হলো? এ নিয়ে আরো আলোচনা হলে এমন বিকৃতি এড়ানো যায়৷”
রবীন্দ্র গানের বদল নিয়ে তেমন প্রতিবাদ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না৷ আলোচনা পুরোটা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে৷ শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘বাঙালি এখন মেরুদণ্ডহীন জাতি৷ তাদের সব প্রতিবাদ ওই ফেসবুক আর সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ প্রতিবাদ করতে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয় না, রাস্তায় নামতে হয় না৷”
-সূত্র: ডয়েচে ভেলে