রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তি ভট্টাচার্য্য
কলকাতা : পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি থেকে চব্বিশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান অতীতের রাজধানী রাজনগর। সিউড়ি কিংবা বোলপুর থেকে সরাসরি বাসে আসা যায় রাজনগর। ধূসর ইতিহাসের গন্ধমাখা খণ্ডহর তথা রাজনগর আজও অতীত রোমন্থন করায়। শুধু তাই নয়, কলন্দর (যারা ভালুক নাচিয়ে বেড়ায়) এবং ঢেকোয়াদেরও (একদা অপরাধপ্রবণ জাতি বলে চিহ্নিত) খুঁজে পাওয়া যাবে এখানে। জেলার পশ্চিমাংশে রুক্ষ জমির ওপর এই গঞ্জের আকর্ষণ ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি, মতিচুড় মসজিদ এবং কালীদহ দিঘি।
রাজনগরের পুরনো নাম নগর। আরও পুরনো নাম লক্ষর। মিথিলা-বিজয় সম্পন্ন করে রাজা বল্লাল সেন রাজপুরীতে প্রবেশের মুখেই সংবাদ পেলেন তিনি পিতা হয়েছেন। উৎফুল্ল রাজা পুত্রের সুলক্ষণ বিচার করে তার নাম রাখলেন লক্ষণ সেন। সেই লক্ষণ সেনের নামে পত্তন করলেন একটি নতুন নগর লক্ষণপুর। লক্ষণপুর ক্রমে ক্রমে লোকের মুখে মুখে হয়ে গেল লক্ষর, ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে নগর এবং এই নগরই রাজাদের বাসভূমি হিসাবে খ্যাতি পায় রাজনগর নামে।
একসময় রাজনগরকে নিরাপদ করা হয়েছিল প্রায় ৩২ মাইল পরিধিযুক্ত ১৮ থেকে ২০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট প্রাচীর দিয়ে ঘিরে। এই প্রাচীরের চারিদিকে ছিল চারটি সুদৃশ্য প্রবেশতোরণ। আজ আর কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। বখতিয়ার খিলজি থেকে আরম্ভ করে গিয়াসুদ্দিন বলবন পর্যন্ত মুসলমান শাসকরা বার বার বাংলা আক্রমণ করলেও রাজনগরের বীর রাজাদের এলাকার মধ্যে পাঠানরা অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু রাজার বৃদ্ধ বয়সে দুশ্চরিত্রা রানির জন্য রাজনগর পাঠানদের হাতে চলে যায়। পাঠান আমলে পশ্চিম রাঢ় বাংলার প্রধান রাজধানী হয়ে ওঠে রাজনগর। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকেও রাজনগরের মুসলমান রাজারা স্বাধীন রাজাদের মতো রাজত্ব করেছেন। পরে ইংরেজের বিরুদ্ধে মীরকাশিমের হয়ে অস্ত্র ধরে রাজাসহ রাজধানী ধ্বংস হয়। শেষ রাজবংশের অধস্তন পুরুষেরা বর্তমান আছেন এখনও। চার-পাঁচটি গ্রামের লোক এখনও রাজা সম্বোধন ও সম্মান করে থাকেন।
দর্শনীয় বস্তুগুলির মধ্যে এখনও গর্বের নিশান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাটতলার কাছে ইমামবাড়া। প্রাচীন ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষ। ইমামবাড়ার সামনে পাশাপাশি দু’টি সমাধি। একটি বিখ্যাত বীর আলি নকি খাঁর আর অন্যটি আলি নকি খাঁর জ্যেষ্ঠ ভাই আহম্মদ উল জমা খাঁর। সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, সেই বিজয়বাহিনীর মূল সেনাপতি ছিলেন আলি নকি। কারও কারও মতে, আলি নকি খাঁ-ই আলিপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতার যুদ্ধে নবাব জয়ী হলে আলি নকির অধীনস্থ সৈন্যগণ কলকাতা লুঠ করেছিল। রাজনগরের মহরমের শোভাযাত্রায় ‘লুঠের কাপড়’ নামে যে বস্ত্র বের করা হয় তা নাকি আলি নকি কলকাতা লুঠের সময় সংগ্রহ করেছিলেন।
রাজনগরের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু ছিল মতিচূড়া মসজিদ, এখন তা ভেঙে পড়েছে। চারিদিকে ঝোপজঙ্গল। দেওয়ালে বড় বড় ফাটল, মাকড়সার জালের আস্তরণ। কোথাও কোথাও ছাদ ঝুলে পড়েছে। মসজিদটি ষোড়শ শতকের তৈরি। একসময় মসজিদের ছয়টি গম্বুজ ছিল, এখন সবই ভেঙে গেছে। সামনের দু’দিকে মিনারের মাথা নেই তবুও ওই মিনারের গায়ের পোড়ামাটির অলংকরণ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। শিল্পরীতিতেও হিন্দু ও মুসলমান উভয় শ্রেণির সংমিশ্রণ ঘটেছে। মসজিদটি পুরাতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত।
রাজবাড়ির পিছনে কালীদহ দিঘি। সেই দিঘির মাঝে এক ছোট দ্বীপ। কথিত আছে, রাজবাড়ি থেকে সুড়ঙ্গপথে দিঘির নীচে দিয়ে ওই দ্বীপে ওঠা যেত। শেষ হিন্দু বীর রাজের পতনের পর যখন রাজনগরে মুসলমান ফৌজদারগণের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় তখন ফৌজদার বাহাদুর খাঁর পুত্র দেওয়ান খাজা কামাল খাঁ বাহাদুর কালীদহের মাঝখানে একটি হাওয়াখানা এবং রাজপ্রাসাদের উত্তরে একটি হামাম নির্মাণ করিয়েছিলেন।
কথিত আছে, ওড়িশার রাজারা ভদ্রকালী মন্দির স্থাপন করে পুজোর জন্য ‘ভারতী’ পদবিধারী ব্রাহ্মণদের নিয়ে এসেছিলেন ওড়িশা থেকেই। তারাই ওড়িশার আদলে কালীদহে হাওয়ামহল নির্মাণ করেন। তবে কালীদহ থেকে জল নিয়ে গিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বেগমের খানদানি চানঘরটি (হামাম) মুসলমান রাজারাই তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে দিঘির মাঝে বড় ভাঙা ইটের স্তূপ ছাড়া কিছুই নেই। তবে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আশ্রয়স্থল এখন কালীদহ। দিঘির কোনায় রয়ে গেছে ইতিহাস স্মৃতিবিজড়িত পুরনো গাব গাছ, যে গাছে ফুল হয় কিন্তু কোনও ফল হয় না। ওই গাছে সাঁওতাল বিদ্রোহের সেনানী মাংলা মাঝিকে ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
উত্তর ভারত থেকে বাংলায় ঢোকার একটি উল্লেখযোগ্য পথ ছিল রাজনগর। কালে কালে এখানের রাজারা তাই গড় গড়েছেন। মোট ১২টি গড় যেমন আলিগড়, খুরিগড়, তরণী পাহাড় গড়, ঘাট পারুলিয়া গড়, বারকেন্দা গড়, কুণ্ডহিত গড়, গামার কুণ্ড গড় প্রভৃতি গড়ের সন্ধান পাওয়া যায় এখানে। এছাড়াও বারুদঘর, হাতিশালা, রাজনগর-কুণ্ডহিত (ঝাড়খণ্ড) রাস্তায় ফুলবাগানের ছোট কালীদহ ও ছোট রাজবাড়ি, বরদাহা ব্রিজ, দেওয়ান সাহেবের মাজার, রানিগ্রামের সুদৃশ্য মদনমোহন মন্দির, মালিপাড়ার ঐতিহ্যশালী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি ঘুরে দেখে নেওয়া যায়।
রাজনগর রাজবাটিতে বর্তমান রাজপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাবে এলাকার ইতিহাস, দেখা যেতে পারে শতাধিক বৎসরের প্রাচীন রাজাদের আমলের শাহি পাগড়ি। রাজার বাংলোয় পড়ে থাকা ‘পালকি’ স্থান পেয়েছে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর ভবনের সংগ্রহশালায়। এই সংগ্রহশালাটিও বেশ আকর্ষণীয় এবং মনোমুগ্ধকর।
সিসাল ফার্ম– রাজনগরকে কেন্দ্র করে ঘোরা যেতে পারে আলিগড়ের সিসাল ফার্ম। আলিগড় রাজনগর থেকে পাঁচ মাইল উত্তরে বিহারের একেবারে সীমান্তে বাস যায়। এখানে সিসাল গাছের তন্তু থেকে দড়ি তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়েছিল ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায়। তবে কারখানাটি বন্ধের মুখে। রাজনগর থেকে সিসাল ফার্মে যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি সেতু সংযোগসাধনের কাজ করে চলেছে, যে সেতুটি কুশকর্ণিকা নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে। সিসাল রাস্তায় গোবড়াগ্রাম লাগোয়া খেজুরিঝুড়ি কাঁদরের উপরেও নির্মিত হয়েছে ছোট্ট সেতু। এখান থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে রয়েছে কয়েকশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত ভদ্রকালী মন্দির। বিশাল বিশাল বৃক্ষ ও গাছগাছালিতে ভরা জায়গাটি যেন মরূদ্যান।
তাঁতলৈ
রাজনগর থেকে সিসাল ফার্মের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে ১২-১৫ কিলোমিটারের মধ্যে দেখা যাবে বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানায় অবস্থিত আরও একটি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল তন্ত্রেশ্বর বা তাঁতলৈ। জঙ্গলের ভেতর একটি ছোট্ট নালা দিয়ে অবিরাম বয়ে চলেছে গরমজলের স্রোত। পাশেই বয়ে চলেছে সিদ্ধেশ্বরী নদী যা এলাকাবাসীর কাছে সিত নদীরূপে পরিচিত।
ওপারে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলা। শুরু সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ি অঞ্চলে। তন্ত্রেশ্বরে রয়েছে একটি শিব মন্দির, পুরনো ও নতুন শ্মশান এলাকা। পুরনো শ্মশান চত্বরে ঝাড়খণ্ড সরকারের তত্ত্বাবধানে বসানো হয়েছে হিলিয়াম গ্যাস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার। তন্ত্রেশ্বরে পৌষসংক্রান্তিতে বহু মানুষ আসেন এখানে গরমজলে স্নান করতে এবং পিকনিক করতে। পৌষসংক্রান্তিতে সারা দিনরাত্রি সিদ্ধেশ্বরী নদীর তীরে মেলা বসে। মেলায় বিশেষ করে আদিবাসী পুরুষ-মহিলা এবং যুবক-যুবতীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। রাজনগরে থাকার কোনও সুব্যবস্থা নেই। রাত্রিবাস করার ইচ্ছা থাকলে থাকতে হবে বক্রেশ্বরে বা পাথরচাপুড়িতে। ট্যাক্সি, মারুতি বা টাটা সুমোর মতো গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে রাজনগরে। অতএব তাদের যে কোনও একটিকে বাহন করে দিনে দিনে ঘুরে নেওয়াই যথার্থ হবে।