কলকাতার সিএমআরআই হাসপাতাল (ক্যালকাটা মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট) । জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, হাঁটু প্রতিস্থাপনের মতো জটিল অস্ত্রোপচার এখন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক রোবোটিক সার্জারিতে। বলা বাহুল্য, গোটা পূর্ব ভারতে সিএমআরআই হাসপাতালই প্রথম রোবোটিক অর্থো সার্জারিতে বড়সড় সাফল্য পেয়েছে।
রোবোটিক্সের ব্যবহার এখন বিশ্বজুড়েই। বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে চিকিৎসা, ডিজিটাল ভারতেও রমরম করে ঢুকে বাড়ছে রোবোটিক্সের ব্যবহার। যে কোনও জটিল অস্ত্রোপচারে রোবোটিক সার্জারির প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন ডাক্তাররা। হাঁটু প্রতিস্থাপনেও এর প্রয়োগ সম্ভব। বিদেশে এখনই রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপন সার্জারি বেশ জনপ্রিয়। খাস কলকাতায় এই সার্জারি করছে একমাত্র সিএমআরআই হাসপাতাল।
ঘরে ঘরে সমস্যা হাঁটুর ব্যথা
হাঁটুর ব্যথা এখন প্রতিটি ঘরের সমস্যা। ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিসের মতোই এই রোগও জাঁকিয়ে বসেছে বাঙালি পরিবারে। বয়স কুড়ি হোক বা পঞ্চাশ, বাতের ব্যথা বা গাঁটে-গাঁটে যন্ত্রণা এখন আর বয়স বিচার করে আসে না। টানা ৭-৮ ঘণ্টা কম্পিউটারে বসে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা তো ভুগছেনই, রেহাই নেই ঘরোয়া কাজ করতে অভ্যস্ত গৃহবধূদেরও। হয়তো জোরে হাঁটতে গেলেন বা পা মুড়ে মাটিতে বসতে গেলেন, এমনি যন্ত্রণায় হাঁটুটা অবশ হয়ে গেল। লিফটে চেপে ওঠানামায় অভ্যস্ত শরীর সিঁড়ি দিয়ে কয়েক পা উঠলেই কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত একটা চিনচিনে ব্যথা টাটিয়ে ধরে। অস্টিও-আর্থ্রাইটিস হোক বা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা অন্য কারণে হাঁটুর ব্যথা হলে হাঁটাচলা করতে প্রাণান্তকর অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। হাঁটুর অস্থিসন্ধির ক্ষয় হতে থাকলে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির কথা ভাবেন ডাক্তাররা।
ব্যথাটা ওঠে অস্থিসন্ধিতে, ধীরে ধীরে চাগাড় দেয় সারা শরীরে
বাতের ব্যথা বা জয়েন্ট পেন শুধু অস্থিসন্থির ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ ঘটায় এমন নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে। প্রাথমিক ভাবে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা থেকে শুরু হয়। এর পরে ধীরে ধীরে অস্থিসন্ধির সচলতা কমে যায়। এ ভাবে চলতে চলতে কারও কারও ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধির হাড়গুলি হালকা বেঁকেও পর্যন্ত যেতে পারে। তখন হাঁটু মুড়ে বসতে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে, অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করতে সমস্যা দেখা দেয়। এইভাবে অস্থিসন্ধিতে যে ইনফ্ল্যামেশন তৈরি হবে তা হার্ট, লিভার, কিডনি সহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও প্রদাহ তৈরি করবে।
এখন কলকাতাতেই হয় অর্থোপেডিক রোবোটিক সার্জারি
হাঁটু প্রতিস্থাপন হল হাইটেক সার্জারি। বছর কয়েক আগেও এত বড় অস্ত্রোপচারের জন্য দক্ষিণে পাড়ি দিতেন এ শহরের রোগীরা। গত দশ বছরে এই শহরের চিকিৎসা পরিষেবাতেও আমূল বদল এসেছে। এখন রোবোটিক হাঁটু সার্জারির দিকে ঝুঁকেছেন এ শহরের অভিজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জেনরাও।
অর্থোপেডিক রোবোটিক সার্জন ডক্টর রাকেশ রাজপুত বলেছেন, চলতি মাসেই রোবোটিক সার্জারিতে হাঁটু প্রতিস্থাপন হয়েছে হাসপাতালে। এখনও অবধি ১০০টি হাঁটু প্রতিস্থান সার্জারি রোবোটিক্সের মাধ্যমে হয়েছে। রোগীরাও অস্ত্রোপচারের পরে খুব দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। ফিডব্যাকও বেশ ভাল।
ডাক্তার বলছেন, এই সার্জারিতে রোবট ব্যবহার করা হয় না। বরং যন্ত্রচালিত হাত (রোবোটিক আর্ম) ব্যবহার করা হয়। পুরো সিস্টেমটাই হয় কম্পিউটার টেকনোলজিতে। তবে রোবোটিক আর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে ডাক্তারের। কীভাবে অস্ত্রোপচার হবে, কোথায় কাটাছেঁড়া করতে হবে তার পুরোটাই আগে থেকে ম্যাপিং করে নেওয়া হয়।
কীভাবে হয় সার্জারি?
ডাক্তার বলছেন, সার্জারির আগে রোগীর সিটি স্ক্যান করে হাঁটুর ৩-ডি রেখচিত্র বের করা হয়। এই ছবি দেখেই ডাক্তাররা বুঝতে পারেন হাঁটু কোন অংশে ক্ষয় হচ্ছে, অস্ত্রোপচার করতে হবে ঠিক কোন জায়গায়। কম্পিউটারে সেই রেখচিত্রের ৩-ডি মডেল বের করে সার্জারির পুরোটাই আগাম ম্যাপিং করে নেওয়া হয়। সেই মডেল দেখে সার্জারি করেন ডাক্তার। তবে নিজের হাতে নয়, যন্ত্রচালিত হাতে।
রোবোটিক সার্জারির সুবিধা কী?
এই সার্জারিতে শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ অংশেরই সার্জারি করা সম্ভব। তার আশপাশের এলাকায় ক্ষয় কম হয়। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, রক্তপাত একদমই সামান্য হয়। মানুষের হাতে অস্ত্রোপচারের সময় যে সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতিও হয়, তা যন্ত্রচালিত হাতে অনেক কম হয়। সহজ করে বলতে গেলে, অস্ত্রোপচার অনেক বেশি নির্ভুল হয় রোবোটিক আর্মের ব্যবহারে। তবে রোবোটিক সার্জারি সব রোগীর জন্যই কিনা তা পরীক্ষা করার পরেই সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তাররা।
আরও একটা বড় সুবিধা হল রোবোটিক সার্জারিতে হাঁটু প্রতিস্থাপন হলে খুব কম সময়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন রোগীরা। সার্জারির পরে চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে হাঁটাচলা শুরু করতে পারেন রোগী। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, ভারতে রোবোটিক হাঁটু সার্জারি ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। হিপ রিপ্লেসমেন্টও হচ্ছে রোবোটিক সার্জারির হাত ধরে। সাফল্যের হারও বেশি। আগামীদিনে দেশের প্রায় সমস্ত বড় হাসপাতালগুলিতে রোবোটিক সার্জারির কদর আরও বাড়বে বলেই আশা রাখছেন চিকিৎসকরা।-বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক