বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
সিয়াম বা রোযা ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ। প্রতিবছর রমযান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ লাভের জন্য রোযা পালন করে থাকেন। ১৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে মুসলমানরা রমযান নিয়মিতভাবে রোজা রেখে আসছেন। আপাতদৃষ্টিতে রোযা সহজ সরল একটি ধর্মীয় আচারণের বিষয়। কিন্তু অনেকের মতে রোযায় সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, শরীর দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু এই কথার কোনও যুক্তি নেই বলে উড়িয়ে দিয়েছেন একদল বিজ্ঞানী। এমনকি রোযা রাখার মানসিক ও শারীরিক সুবিধা গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করেছেন তাঁরা। শুধু ধর্মীয় রীতি অনুসারে নয়, রোযা রাখার অনেক উপকারিতা রয়েছে এমনটাই জানিয়েছেন তাঁরা। তবে মুসলমানদের জন্য রমযান মাসে রোযা রাখা ফরজ।
এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহ ভীরুতা অবলম্বন করতে পারো। সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক হয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। (কুরআন: অধ্যায় ২, আয়াত ১৮৩-১৮৪)। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা তা জানতে।
সুতারং পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যাদের জন্য রোযা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া দেওয়া। সুতারং ফিদিয়া স্বরূপ একজন গরীবকে খাবার খাওয়াতে বলা হয়েছে।
রোযা রাখার স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারিতাঃ বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের বেলায় কম খাদ্য গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন- উচ্চ কোলেস্টেরল, হৃদরোগ ও স্থূলতা প্রতিরোধ করে।
হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানিn হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্য রোজা উপকারী। রোযার ফলে রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে। তা ছাড়া রোযা রাখার কারণে স্ট্রেস হরমোন করটিসেলের নিঃসরণ কমে। এতে পরিপাক ক্রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। রোযার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে বিধায় মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়, কর্মোদ্দীপনাও বাড়ে, যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। অধিকাংশ হাঁপানি রোগীর ক্ষেত্রেই রোযা উপকারী।
কোলেস্টেরলের মাত্রা বজায় রাখে: জীবনযাত্রা ও বদ অভ্যাসের কারণে অনেকেরই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ছে। কিন্তু রমযানে রোযা রাখলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যায়। রোযা রাখলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কার্ডিওলজিস্টরা এক সমীক্ষার মাধ্যমে দেখতে পান, রোযা রাখার ফলে লিপিড প্রোফাইলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরলে ভুগছেন এমন রোগীদের রক্তে কোলেস্টেরল দ্রুত কমতে শুরু করে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য: যেসব মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন তাদের জন্য রোযা রাখা খুব উপকারী এমনটাই বলছে গবেষণা। রোযার সময় সঞ্চিত চিনি (গ্লাইকোজেন আকারে) লিভারে জমা হয়। সেটি শরীরে উপকারে লাগে। এই সঞ্চিত চিনি ব্যবহার করতে শরীরের সময় লাগে ৮ ঘন্টা পর্যন্ত।
স্থূলকায় রোগীদের জন্য: স্থূলতা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। স্থূলতা আপনার ধমনীতে চর্বিযুক্ত উপাদানের বিকাশ ঘটাতে পারে, তাই হার্টে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলস্বরূপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। দীর্ঘ সময় না খাওয়ার ফলে যখন গ্লাইকোজেন সঞ্চয়গুলি হ্রাস পায়, তখন শরীর গ্লাইকোজেনের পরিবর্তে শক্তির জন্য চর্বি ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত চর্বি কমে, ফলে শরীরের ওজন কমবে।
হজম ও রোগ প্রতিরোধক উপকারিতা: রোযা পাকস্থলীর অ্যাসিড কমায়, যার ফলে খাবার হজম হয় এবং ব্যাকটেরিয়া কমে যায়। রোযা অন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে। রমযান মাসে পুরো এক মাস রোযা রাখলে নতুন শ্বেত রক্ত কণিকার উৎপাদন উদ্দীপিত হয়। এটি পুরো ইমিউন সিস্টেমের পুনর্জন্ম। এটি বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য শরীরকে আরও শক্তিশালী করবে।
মস্তিষ্কের উন্নতি: মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটে রোযা রাখলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে ফাস্টিং। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উন্নতি ঘটে। একইভাবে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত হরমোন কর্টিসলের পরিমাণ কমার কারণে মানসিক চাপও কমে।
জ্ঞানের প্রসার: রোযা জ্ঞান এবং চিন্তা ক্ষমতা উন্নত করে। এটি নিউরোডিজেনারেশনকে ধীর করে, মস্তিষ্কের ক্ষতি কমায় এবং স্ট্রোকের পরে কার্যকরী পুনরুদ্ধারের উন্নতি করে।
আল্লাহর সন্তুষ্টি:রোযার সবচেয়ে সুন্দর উপকার হল আল্লাহর সন্তুষ্টি। হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ বলেন, ‘ইবনে আদমের প্রতিটি কাজই তার জন্য, রোযা ছাড়া, তাই এটা আমার জন্য এবং এর প্রতিদান দেওয়া হবে’।
মুসলমান মাত্রেই অবশ্যই পুরো রমযান মাসে রোযা রাখতে হবে। এর উপকারিতা শুধুমাত্র ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। রোযা আমাদের অনেক শারীরিক ও মানসিক উপকার করে। এটি অনেক বিপজ্জনক রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করতে হবে, তাহলেই প্রকৃত ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।