শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তিনি ছিলেন বিবাহবিচ্ছিনা, চার সন্তানের জননী। তার পরেও মনের জোরে, একা লড়াই করে বলিউডের প্রথম সারির নায়িকা হন তিনি। এখনকার সময়ে এমনটা আলোচনা হওয়ার মতো বিষয় না হলেও, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগে, আজ থেকে ৭-৮ দশক আগে এমনটা মোটেও খুব প্রচলিত ছিল না। সে সময় থেকেই তিনি যেন সিঙ্গেল মাদারদের অনুপ্রেরণা। কিন্তু তাঁর কাহিনি তাঁর লড়াই প্রায় বিস্মৃত। তিনি লীলা চিটনিস, ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের যুগে এক সাহসী নায়িকা।
কেমন ছিল তাঁর জীবন সংগ্রাম? কেনই বা সিনেমা লাইনে এলেন? শুধুই পেটের দায়ে? তৎকালীন আর পাঁচ জন নায়িকার থেকে লীলা চিটনিস ছিলেন অনেক উচ্চশিক্ষিতা ও সভ্রান্ত পরিবারের কন্যা, সেই সঙ্গে অভিজাত পরিবারের বধূও। সিনেমায় ‘নামার’ কথা তাঁর ছিল না। তাই ফিরে দেখতে হয় তাঁর শুরুর গল্প।
কর্নাটকের ধরওয়াদে এক মারাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে লীলার জন্ম ১৯০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। তাঁর পিতা ছিলেন সেযুগে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। লীলা নিজেও ছিলেন গুণবতী, বিদূষী।
কিন্তু সমাজের ও পরিবারের পুরনো নিয়ম মেনে মাত্র পনের বছর বয়সে লীলার বিয়ে হয় তাঁর থেকে অনেক বেশি বয়স্ক এক চিকিৎসক গজানন চিটনিসের সঙ্গে। স্বামীও উচ্চশিক্ষিত। তাঁরা ব্রিটেনে সংসার পাতেন কিছুদিন। এই দম্পতি স্বাধীনতা সংগ্রামী মানবেন্দ্রনাথ রায়কে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতেন ব্রিটেন থেকে।
অল্প সময়েই চার-পুত্র সন্তানের জননী হয়ে যান লীলা। এর পরেই নানা বিষয়ে অশান্তি বাড়ে সংসারে। শেষ পর্যন্ত বিবাদ থেকে বিচ্ছেদ। ভেঙে যায় সংসার, ছাড়তে হয় স্বামীর ঘর।
এককাপড়ে সন্তানদের নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন লীলা। আত্মসম্মান ছিল প্রখর। তাই না করেছেন আপস, না খুঁজেছেন দ্বিতীয় মানুষের আশ্রয়। শুরু হয় তাঁর একার জোরে পায়ের তলার মাটি শক্ত করার লড়াই। ব্রিটেন থেকে চলে আসেন নিজের দেশে, নিজের জায়গায়। প্রথমে কিছুদিন স্কুল শিক্ষিকা হিসেবে একটি স্কুলে যোগ দেন।
এর পরে হঠাৎই জেগে ওঠে অভিনয়ে সুপ্ত বাসনা। ছোটবেলা থেকে শখ থাকলেও, সত্যিই কখনও অভিনয় করবেন বলে ভাবেননি। মারাঠি নাট্যদলে যোগ দেন তিনি। কিন্তু তাতে করে চার সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই লীলা চলে এলেন মুম্বই। বলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘এক্সট্রা’ হিসেবে যোগ দিলেন। বেশিরভাগ ধর্মীয় ছবি ও স্টান্ট মুভিতে কাজ করতেন দক্ষতার সঙ্গে।
১৯৩৭ সালে ‘জেন্টলম্যান ডাকু’ ছবি লীলা চিটনিসের জীবনে অন্যতম। শুরু থেকেই যে লীলা সমাজের মিথ ভেঙেছেন বারবার, সে লীলা ওই যুগে এরকম একটা ছবিতে, ক্রসড্রেস পোশাক পরে, পুরুষের সাজে, মহিলা অভিনেত্রীকে চুম্বনের দৃশ্যে অভিনয় করেন। এই ছবির পোস্টারে বড় করে লীলার ক্রসড্রেস লুকের ছবিও হিট হয়। এখন তো কত ক্রসড্রেস নিয়ে হৈচৈ, অথচ এমন একটা পদক্ষেপ সেই যুগেই করতে পেরেছিলেন লীলা।
১৯৩৯ সালে লীলার ভাগ্য ফিরল বলিউডের প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান ‘বম্বে টকিজ’ এ যোগদান করে। অশোক কুমারও তখন নবাগত অভিনেতা। অশোক কুমারের বিপরীতে নায়িকার রোল পেলেন লীলা। ছবির নাম ‘কঙ্গন’। ছবিটা বক্সঅফিসে সুপারহিট করল এবং অশোক কুমার ও লীলা চিটনিস জুটি হিসেবে আরও ছবির অফার পেলেন।
এর পরে ‘আজাদ’, ‘বন্ধন’, ‘ঝুলা’– একের পর এক অশোক-লীলা জুটি সুপারহিট। অশোক কুমার পরবর্তীকালে বলেছিলেন, রোম্যান্টিক অভিনয়ের সারসত্য তাঁকে শিখিয়েছিলেন লীলা চিটনিস। লীলা তাঁকে বলেছিলেন, “হৃদয় খুলে অভিনয় করার আগে চোখ খুলে চোখে চোখ রেখে প্রেমের অভিনয় করো।” লীলার সেই টিপস আজীবন মনে রেখেছিলেন অশোক কুমার।
বিজ্ঞাপন জগতে একটা হিসেব থাকে, কাকে দিয়ে কোন প্রোডাক্ট সামনে নিয়ে আসা হলে কতটা বিক্রি বাড়ার সম্ভাবনা আছে। ঠিক সেই কারণেই চিরকাল বড় তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে এসেছে বিজ্ঞাপন জগত। প্রথম সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট সম্ভবত লাক্স সাবানের কোম্পানিই শুরু করে। তাই সে যুগ থেকে এ যুগ, সমস্ত প্রথমা বলিউড ও টলিউড নায়িকারা লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপন মুখ হয়েছেন। এটা একটা সম্মান বা কৃতিত্ব হিসেবে নায়িকাদের বিবেচিত হয় নায়িকাদের কেরিয়ারে।
কিন্তু লাক্স সাবান প্রথম কাকে বিজ্ঞাপনী মুখ করেছিল জানেন? এই লীলা চিটনিসকেই। প্রথম থেকেই লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনের মডেল বদলে বদলে যেত বছর বছর। সেটা দেখে বোঝা যেত, কে সেই সময়ের এক নম্বর তারকা। লাক্স শুরু করে ১৯২৯ সালে লীলা চিটনিস কে দিয়ে। তিনিই প্রথম লাক্স সাবান কোম্পানির তারকামুখ। তার পরে মীনা কুমারী‚ সুচিত্রা সেন‚ সায়রা বানু‚ আশা পারেখ‚ শর্মিলা ঠাকুর থেকে এখনকার রাইমা সেন, ক্যাটরিনা কাইফ– সেই ধারা চলে আসছে।
চল্লিশের দশকের শেষে লীলা বুঝে গেলেন, তাঁর নায়িকা ক্যারিশমার পড়তি যুগ আসতে চলেছে। তাই পথ বদলে তিনি চরিত্রাভিনেত্রীর রোলে বিশেষত মায়ের রোলে বলিউডে নতুন মাত্রা যোগ করলেন। শহীদ, আওয়ারা, নয়া দৌড়, মা, সাধনা, কালা বাজার, গঙ্গা যমুনা, গাইড, সত্যম শিবম সুন্দরম প্রভৃতি ছবিতে মায়ের রোলে আজও নজর কাড়েন লীলা চিটনিস। রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার– সকলের মায়ের ভূমিকায় কাজ করেছেন লীলা চিটনিস।
লীলা চিটনিস পরে ছবির পরিচালনা ও প্রযোজনাও করেছেন। ১৯৪২ সালে ‘কিসিসে না ক্যাহেনা’ ছবি প্রযোজনা করেন তিনি। ১৯৫৫ সালে পরিচালনা করেন ‘আজ কি বাত’। সে ছবিতে তাঁর দুই পুত্রও অভিনয় করেছিলেন।
এছাড়াও লীলা ছিলেন রাজনৈতিক জগতের এর দৃঢ় কর্মী। স্বাধীনতা সংগ্রামী মানবেন্দ্র নাথ রায়কে সাহায্য একদিন লীলাই করেছিলেন যে। আশির দশকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন লীলা। তাঁর শেষ ছবি হল ‘দিল তুঝকো দিয়া’। ছেলেরা থাকত আমেরিকায়। তাই শেষ বয়সে সেখানেই ফিরে যান লীলা চিটনিস। রুপোলি পর্দাকে চিরবিদায় জানান তিনি।
কিন্তু শেষ জীবনে সব কিছু গন্ডগোল হয়ে যায়। গ্ল্যামার ও লড়াইয়ের যৌথরূপে এক সময়ে দাপিয়ে জীবন কাটালেও, বৃদ্ধবেলায় সঙ্গী হয় নিদারুণ অনটনে। পুত্ররা সেভাবে মায়ের পাশে দাঁড়ায়নি বলে শোনা যায়। অথচ এই পুত্রদের বুকে করেই লড়াই শুরু করেছিলেন লীলা।
২০০৩ সালের ১৪ জুলাই আমেরিকার কানেক্টিকাটে লীলা চিটনিস প্রয়াত হন ৯৩ বছর বয়সে।
কখনও ঠোঁটে সিগারেট, কখনও বা ক্রসড্রেস পরে মহিলাকে চুম্বন করে, কখনও আবার নায়কের বাহুলগ্না হয়েও নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা স্টার লীলা চিটনিস। তবে সাহসী দৃশ্যে ঝড় তুললেও তাতে শিক্ষিত রুচির ছাপ রেখেছিলেন তিনি। উদ্দামতাকে কখনও প্রশয় দেননি। শিল্প আর অশ্লীলতার লক্ষণরেখাটা বুঝতেন অতদিন আগে। অথচ সময়ের থেকে কত আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
যে কোনও শিল্পীর জীবনে তো চড়াই-উতরাই থাকেই। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেই প্রথম দিকে ছকভাঙা সাহসী নারী হিসেবে তাঁর নাম লেখা থাকবে আজীবন। সদ্য ১১০তম জন্মবার্ষিকী পেরোলেন তিনি। এ প্রজন্মের কাছে তিনি বিস্মৃত হলেও ইতিহাস সব কিছুই মনে রাখে।