Home First Lead এমি-লিও-স্কালোনির ত্রিবেণী সঙ্গমেই বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার

এমি-লিও-স্কালোনির ত্রিবেণী সঙ্গমেই বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

গতবছর কোভিডে বাবা, মা, দাদাকে হারানো এক মধ্যবিত্ত কিশোরের গল্প আজ। এবং এটা এমি-লিও-স্কালোনিরও গল্প।

তার দুর্বল দাদাকে যখনই অহেতুক আক্রমণ করত বন্ধুরা, কিশোরটি ঝাঁপিয়ে পড়ত তাকে বাঁচাতে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হত। পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে তার প্রিয় দলের গোলকিপারকে একের পর এক নিশ্চিত গোল আর পেনাল্টি বাঁচাতে দেখে সেসব কথা মনে পড়ে গেল ছেলেটার। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ না থাকলে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে বিশ্বকাপ স্পর্শ করতে পারত না আর্জেন্টিনা । গোল্ডেন গ্লাভস পাওয়া এমিলিয়ানো মার্টিনেজ কাতার বিশ্বকাপে তিনকাঠির নীচে যে খেলা দেখালেন, তা ভুলতে সময় লাগবে বা হয়ত তা ভোলা যাবে না কোনওদিনই।

১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে বিশ্বকাপ স্পর্শ করতে পারত না আর্জেন্টিনা, লিওনেল মেসি  না থাকলেও। পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে লিওনেল মেসিকে দেখে এই কিশোরের আজ মনে পড়ে যাচ্ছিল তার মায়ের কথা। তার মায়ের যোগ্য সঙ্গত করে যাওয়া তার দিনআনি দিন খাই রোজগেরে বাবার পাশে। তারা ভাইবোনেরা কেউ তার মায়ের সূক্ষ্ণ দৃষ্টিও এড়াতে পারত না, সবার খুঁটিনাটি সব চাওয়া পাওয়া ব্যালেন্সিং করা ছিল তার মায়েরই নিজের হাতে। তাদের ভাইবোনদের কারও এতটুকু মনখারাপের ডিফেন্সিং জোনে অথবা তাদের আনন্দঘন মুহূর্তগুলোর অ্যাটাকিং থার্ডেও সবসময় পাশে থাকতেন তাদের মা। প্রাণপণে সেসব শিখে নিত সেই কিশোর। সবসময় পাশে থাকার সেই অমোঘ শিক্ষা আজও সে ভুলত পারেনা কখনই।

এবারের কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা লিওনেল মেসিকে দেখে সবার সঙ্গে মিলেমিশে, এক হয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষা, সংসারের ছোটখাটো আনন্দকে শুকোতে না দেবার শিক্ষা দেওয়া তার মায়ের কথা আচমকাই মনে পড়ে যায় সেই কিশোরের। খেলার হারা-জেতা-আগে-পরে-মধ্যান্তরে এক টিম হয়ে জ্বলার প্রেরণা তো খেলোয়াড় লিওনেলের থেকেই রোজ রোজ পেয়েছে ‘টিম আর্জেন্টিনা’। ডাচদের টাইব্রেকারে হারিয়ে গোটা টিম উল্লাসরত, একপাশে শুয়ে পড়ে একা কাঁদছেন টাইব্রেকারে জেতানোর নায়ক গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। লিওনেল মেসি উল্লাসরত টিমকে পেরিয়ে ছুটে গেলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজের কাছে, তারপর গভীর আলিঙ্গন, ‘কোনও কথা না বলি’ হাজার কথা বলে যাওয়া। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় লিওনেল তাঁকে নিয়ে গেল সেই মায়াবী মায়ের স্মৃতিসৌধের পাদদেশে।

সেই কিশোরের মনে পড়ছিল তার বাবার সংসার চালাতে রোজকার ‘ফার্স্ট টু লাস্ট ড্যান্স’। তার বাবার নিজের আর আর তার মায়ের ছোট্ট চাকরিতে যা ছিল মাসান্তের আগমনী সম্বল, তারই মধ্যে এদিক ওদিক, এরকম সেরকম, ইত্যাদি প্রভৃতি নানারকম পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে তিনি সংসারের সার বুঝে নিতেন, সং না সেজে। প্রতিপক্ষ হিসেবে গিলতে আসা জিনিসের দাম এবং আরও অনেক বাধাকে বুঝে নিয়ে টপকে যেতেন হাসিমুখে, নিজের মত করে। বিনা অভিযোগে প্রাণান্তকর খাটনির দিনান্তে টিউশনি, বেশ রাতে বাড়ি ফিরে সেই কিশোর ও তার দুই ভাইবোনকে নিয়ে পড়ে থাকা, জীবন এগিয়ে যেত এরই মধ্যে। তার বাবা এভাবেই তাকে শিখিয়ে গেছেন, যা আছে তারই মধ্যে অ্যাডজাস্ট করে বেঁচে নেবার শিক্ষা। এবারের কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনিকে  দেখে এসব কথা আচমকাই মনে পড়ে যায় সেই কিশোরের। প্রতিপক্ষ বুঝে টিম সাজিয়ে, হাতে যা আছে তা দিয়েই হাসিমুখে নানা ফর্মেশন ভেঙে গড়ে আবেগহীন সূক্ষ্ণতায় লক্ষ্যস্থির রেখে এগিয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি তাকে নিয়ে যায় সেই লড়াকু বাবার স্মৃতিসৌধের পাদদেশে।

২০২২-এর ১৮ ডিসেম্বর কাতারে এই এমি-লিও-স্কালোনির ত্রিবেণী সঙ্গমই বিশ্বকাপ দিয়ে গেল ‘টিম আর্জেন্টিনা’কে। এটা না হলেও দাদা, বাবা আর মায়ের স্মৃতিসৌধের পাদদেশে নতুন করে বসতে পারা সেই কিশোরের তাতে কিছু এসে যেত না। এমি-লিও-স্কালোনির জন্য জয়ী ‘টিম আর্জেন্টিনা’র সাফল্যে সেই কিশোর আর একটু বেশি আনন্দিত হল এই যা। চারিদিকে বাজি ফাটছে, মিছিল বেরিয়েছে, এই পশ্চাৎপটে এখন তার দাদা, বাবা আর মায়ের মুখে শোনা মারাদোনাকেও খুব মনে পড়ছে তার।-দেবাশিস সেনগুপ্ত