ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের স্বপ্ন যাঁদের দুঃসাহসিক এবং জোরালো নেতৃত্ব ছাড়া প্রায় অধরাই থেকে যেত, লোকনাথ বল তাঁদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। লোকনাথ বল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মাস্টারদার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিযান চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্বদান করেছিলেন লোকনাথ বল। জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধেও দক্ষ হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি এবং সেই যুদ্ধে তাঁরা জয়লাভও করেছিলেন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে। তবে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে আন্দামানের জেলে নির্বাসিত জীবনযাপনও করতে হয়েছিল তাঁকে। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর চেহারার অনেকখানি মিল থাকার কারণে অন্য বিপ্লবীদের মতো তাঁর পক্ষে গা ঢাকা দিয়ে থাকাও কিঞ্চিৎ মুশকিল ছিল। লোকনাথ বলকে বিপ্লবীরা ভালবেসে ‘সোনাদা’ বলে সম্বোধন করতেন। স্বাধীনতা লাভের পরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লোকনাথ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। সেসময় এক আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। এছাড়াও আমৃত্যু তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯০৮ সালের ৮ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত চট্টগ্রামের ধোরলা গ্রামে লোকনাথ বলের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম প্রাণকৃষ্ণ বল। লোকনাথের ছোট ভাই হরিগোপাল বল ছিলেন অত্যন্ত সাহসী বিপ্লবী। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন হরিগোপাল। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘টেগরা’। ছোটবেলা থেকেই ব্যায়ামের আখড়ায় শরীরচর্চা করতে দাদা লোকনাথের সঙ্গে যেত হরিগোপাল। লোকনাথের মা যে মাস্টারদা সূর্য সেনের সেনাবাহিনীতে লোকনাথকে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন ইতিহাস তার সাক্ষী রয়েছে।
সশস্ত্র আন্দোলনের সময়কার অন্যতম প্রভাবশালী এবং দক্ষ নেতা মাস্টারদা নামে পরিচিত সূর্যসেন অনুভব করেছিলেন যে, যদি একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অল্পকালের জন্য হলেও চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করা যায় তাহলে তা গোটা ভারতবর্ষের কাছে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সফলতার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, সারা দেশব্যাপী এক চরম উত্তেজনা ও আশা ছড়িয়ে পড়বে এবং ইংরেজ শাসনের ভিতকে হয়তো টলানো যাবে কিছুটা। এই উদ্দেশ্যেই মাস্টারদা গঠন করেছিলেন ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্রী সেনা’ বা ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’। কিন্তু পাশাপাশি মাস্টারদা এও বুঝেছিলেন যে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী অত্যন্ত শক্তিশালী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা অর্জনের জন্য যথোপযুক্ত অস্ত্রেরও প্রয়োজন আছে। সেইসব অস্ত্র খোদ ব্রিটিশদের ভান্ডারেই সঞ্চিত রয়েছে এবং সেখান থেকেই তা হস্তগত করবার পরিকল্পনা কষতে শুরু করেন মাস্টারদা। এভাবেই ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন অভিযানের পরিকল্পনা দানা বেঁধে ওঠে। অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ-সহ অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে একনিষ্ঠ এই স্বদেশপ্রেমী লোকনাথ বল বুকে স্বাধীনতার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে যৌবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন মাস্টারদার ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে। কেবলমাত্র একজন সৈনিক হিসেবেই নয়, নেতৃত্বদানের অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি মূল অভিযানের চারটি অংশের একটিতে সামনে থেকে নেতৃত্বদানও করেন। জুনিয়ররা তাঁকে ‘সোনাদা’ নামে সম্বোধন করত। উল্লেখযোগ্য যে, মাস্টারদার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অনুশীলন সমিতিতেও যোগ দিয়েছিলেন লোকনাথ।
মূলত চারটি ভাগে এই অস্ত্রাগার লুন্ঠন অভিযানকে ভেঙে নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, একটি দল টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন ব্যবস্থা ধ্বংস করে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেবে, দ্বিতীয় দল আক্রমণ করবে ইউরোপীয়ান ক্লাবে, তৃতীয় একটি দল ব্রিটিশ পুলিশের একটি অস্ত্রাগার লুঠ করবে এবং চতুর্থ দলটি অক্সিলারি আর্মির বা সহায়ক সামরিক সেনার অস্ত্রাগার লুন্ঠন করবে। এই অক্সিলারী আর্মি ফোর্সের অস্ত্রভান্ডার বিপ্লবীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ পুলিশের অস্ত্রাগারের মতো এখানে কেবলই রাইফেল বা রিভলবার নয়, ছিল আরও অত্যাধুনিক মানের থ্রি নট থ্রি আর্মি রাইফেল, যা থেকে একসঙ্গে দশটি গুলি ছোঁড়া যায়। এই চতুর্থ দলের নেতা ছিলেন লোকনাথ বল এবং সঙ্গে ছিলেন নির্মল সেন ও দশজন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকানের সেনা। ঠিক হয়েছিল বিপ্লবী নেতারা ব্রিটিশ পুলিশের পোশাক পরিধান করে অভিযানে অগ্রসর হবে। সামরিক পোশাক পরিহিত লোকনাথকে চিনতে ভুল করে অস্ত্রাগারের প্রহরী সেলাম করলে বন্দুক বাগিয়ে গুলি ছোঁড়েন লোকনাথ। এরপর রিভলবার হাতে মেজর ফেরেল ছুটে এলে তাঁকেও হত্যা করা হয়। জেনারেল লোকনাথের আদেশে এরপর অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দেয় বিপ্লবীরা। কিন্তু রাইফেলের সন্ধান পেলেও তাঁদের দুর্ভাগ্য যে, বারুদ, কার্তুজ ইত্যাদি তাঁরা খুঁজে পাননি। ব্রিটিশরা এই হামলার জবাব সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারেনি কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপ্লবীরা ধ্বংস করে দিয়েছিল।
এই ঘটনার চারদিন পর অর্থাৎ ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার সৈন্য প্রেরণ করলে চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্মুখসমরে লিপ্ত হয় বিপ্লবীরা। এই যুদ্ধেই লোকনাথ বলের ছোটভাই চোদ্দ বছর বয়সী হরিগোপাল বল ওরফে টেগরা-সহ আরও এগারো জন বিপ্লবী শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রাণত্যাগের আগে টেগরা লোকনাথকে সোনাভাই বলে সম্বোধন করেছিল, কিন্তু সংগ্রামের ক্ষেত্রে এমন হৃদয়বৃত্তির কোনো স্থান নেই বলেই মনে করতেন লোকনাথ। তিনি মৃত্যুপথযাত্রী টেগরাকে বলেছিলেন যে, তাঁরা সৈনিক, সোনাভাই বলে সেখানে কেউ নেই। তবে টেগরার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রোখ চেপে যায় লোকনাথের। তিনি সঙ্গীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন মেশিনগান সম্পূর্ণ নীরব না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালাতে। এই পাল্টা আক্রমণে ব্রিটিশরা কিঞ্চিৎ দিশেহারা হয়েছিল। তবে এই অভিযান ঠিক সফল না হলেও ব্রিটিশ বিরোধিতার এক জোরালো দৃষ্টান্ত তৈরি করে। অনেক বিপ্লবী শহীদ হলেও লোকনাথ বল অন্য অনেক বিপ্লবীর সঙ্গে পালাতে সক্ষম হন। সেখান থেকে পালিয়ে তাঁরা ফরাসীদের অঞ্চল চন্দননগরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। লোকনাথের কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথার টুপি এবং গোটা পরিচ্ছদটার সঙ্গে দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসুর বিস্তর সামঞ্জস্য ছিল। এই মিলের কারণেই কোথাও বেশিদিন লুকিয়ে থাকা অন্যদের তুলনায় তাঁর পক্ষে একটু মুশকিলের ব্যপারও ছিল। শেষ পর্যন্ত গণেশ ঘোষ এবং লোকনাথ বল ব্রিটিশদের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গ্রেফতার হন ১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৩২ সালের ১ মার্চ পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাবাসের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের।
১৯৪৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর মেক্সিকোর এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের গড়ে তোলা র্যাডিকাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগদান করেন লোকনাথ বল। কিন্তু পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন দীর্ঘদিন। কংগ্রেসে যোগদান করবার পর একবার এক আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। যদিও তা কোনও মতে কাটাতে পেরেছিলেন। এছাড়াও ১৯৫২ সালের ১ মে লোকনাথ কলকাতা কর্পোরেশনের দ্বিতীয় ডেপুটি কমিশনার এবং ১৯৬২ সালে প্রথম ডেপুটি কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি ঘটেছিল তাঁর। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই কর্পোরেশনের এই ডেপুটি কমিশনারের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি।
-সংগৃহীত