বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
আজও অনেক মানুষ শকুনকে অশুভ পাখি হিসাবে দেখে। অনেকে লম্বা গলার ধূসর ফ্যাকাশে এই পাখিদের মৃত্যু বা মহামারীর প্রতীক হিসেবেও কল্পনা করেন।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, শকুন যেহেতু মরা পশুর মাংস খায়, তাই ধরে নেওয়া হয়, জীবিত প্রাণীর মৃত্যু কামনা করে এই পাখি। গৃহস্থ বাড়িতে শকুন বসলে, বা ভিটের ওপর দিয়ে শকুন উড়ে গেলে, তা অদূর অমঙ্গলের আভাস বলেই ধরে নেয়া হয়। প্রাচীন বাংলার প্রবাদ-প্রবচন, উপকথার বুকেও শকুনকে অশুভ লক্ষণের প্রতীক হিসাবেই বারবার আঁকা হয়েছে।
শকুন নিয়ে গোড়া থেকেই কিন্তু মানুষের মনোভাব এমনটা ছিল না। প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে প্রায় দেবতার মর্যাদা পেত এই পাখি। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় নেখেত নামে এক দেবীমূর্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। জ্ঞানের দেবী তিনি। এই দেবীর মাথা শকুনের মতো। মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুসারে, নেখন শহরকে রক্ষা করতেন এই দেবী। সাদা শকুনের পালকের তৈরি জামা পরতেন দেবী নেখেতের প্রধান পুরোহিতেরা।
হায়ারোগ্লিফিক্স লিপিতে ইজিপশিয়ান শকুনের ছবি পাওয়া যায়, যা সম্ভবত ইংরেজি ‘A’ অক্ষরটির সূচক। এই শকুনকে পবিত্র মনে করা হত এবং স্বয়ং ফারাও তাদের রক্ষা করতেন। শুধু ইজিপ্টেই নয়, প্রাচীন গ্রিসেও শকুন ছিল বসন্তের প্রতীক।
রামায়ণ ও মহাভারতে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে শকুন প্রসঙ্গ। রামায়ণের কথাই ধরা যাক। বনবাসকালে ছদ্মবেশী রাবণ সীতাকে অপহরণ করে আকাশপথে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন এক বিরাটকায় পাখি, সেই পাখির নাম জটায়ু।
জটায়ু আর তাঁর দাদা সম্পাতি ছিলেন দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন পাখি, যাদের ‘ডেমি গড’ বলা হয়। সূর্যের সারথি অরুণের ঔরসে শ্যেনীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন এই দুই ভাই। মহাকাব্যের কাহিনি অনুসারে, জটায়ু ও সম্পাতি দুই ভাই কমবয়সে ইন্দ্রলোক জয় করবার ইচ্ছায় আকাশপথে পাড়ি দিয়েছিল স্বর্গের দিকে। পথে সূর্যের প্রচণ্ড কিরণে জটায়ু জ্ঞান হারালে দাদা সম্পাতি নিজের পাখা বিস্তার করে জটায়ুকে রক্ষা করেন। কিন্তু সূর্যের প্রচণ্ড তাপে পুড়ে যায় সম্পাতির পাখা। ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে তারপর থেকে বিন্ধ্যপর্বতেই নির্জনে বসবাস করতেন তিনি।
সীতাহরণের পর খুঁজতে খুঁজতে বানররা বিন্ধ্যপর্বতে উপস্থিত হলে, সম্পাতি দিব্যচক্ষুর প্রভাবে রাবণ ও লঙ্কাপুরীর বৃত্তান্ত জানান রামসেনাকে। সীতা যে লঙ্কায় বন্দিনী আছেন তাও বলেন। সাগর পার হয়ে সীতাকে উদ্ধারের পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি।
এই মহাকাব্যে দৈব পাখি সম্পাতির যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় পাহাড়ের চূড়ায় শকুন গোত্রের বিশালাকার কোনও পাখিকে দেখেই ‘ডেমি গড’ সম্পাতির কল্পনা করেছিলেন রামায়ণের স্রষ্টা।
মহাভারতের দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার কাহিনি কে না জানে? ঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা মেনকার গর্ভে শকুন্তলার জন্ম হয়। কিন্তু সদ্যোজাত মেয়েকে ত্যাগ করেন ঋষি বিশ্বামিত্র। মেয়েকে সঙ্গে নিতে চাননি মা মেনকাও। এক্ষেত্রেও একলা জঙ্গলে পরিত্যক্ত ছোট্ট শিশুকন্যার প্রাণ রক্ষা করেছিল বাজ বা শকুন গোত্রের কোনও পাখি।
আজকের পৃথিবীতে শকুন একটি মহাবিপন্ন পাখি। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮০ সালে ভারত উপমহাদেশে প্রায় ৪ কোটি শকুন বাস করত। মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যাটা কমতে কমতে কয়েক হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের এই দ্রুত বিনষ্টির কারণ হিসাবে আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের পাশাপাশি শকুন সম্পর্কে আমাদের বর্তমান মনোভাবও অনেকাংশে দায়ি।