৫০ হাজারের বেশি খেজুর, তাল, দেবদারু, নিম ও সেগুনের বীজ বিভিন্নস্থানে বপন এবং বিতরণ করেছেন
স্বপ্না দেবনাথ
সবুজে আচ্ছাদিত বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন যশোরের আনন্দ সরকার। ব্যক্তিগত খরচে গত তিন বছরে তিনি রোপণ করেছেন প্রায় ১৩ হাজার গাছের চারা। ৫০ হাজারের বেশি খেজুর, তাল, দেবদারু, নিম ও সেগুনের বীজ বিভিন্নস্থানে বপন এবং বিতরণ করেছেন তিনি। ২০১৯ সালের আগস্টে শার্শার বাগআঁচড়া-চালিতাবাড়িয়া সড়কে একহাজারের বেশি খেজুর গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে আনন্দ তার কাজ শুরু করেন। বর্তমানে যশোর শহরসহ শার্শা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ১৩ হাজারের বেশি গাছের চারা রোপণ করেছেন আনন্দ। শুধু রোপণ নয়, নিয়মিত গাছের পরিচর্যাও করেন তিনি। শিশুদের গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতে নিজ খরচে বিভিন্ন সময়ে গাছের চারা উপহার দেন। বড়দের উদ্বুদ্ধ করতে ফেসবুকে প্রচারণা চালান। কেউ চাহিদা দিলে নিজ অর্থে সাধ্যমতো গাছের চারা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা সম্পন্ন করা আনন্দের জন্ম শার্শা উপজেলার দীঘা গ্রামে। বাবা পণ্ডিত সরকার পেশায় একজন নরসুন্দর। আনন্দ যশোর শহরে টিউশনি করিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পাশাপাশি টিউশনির টাকা দিয়েই তিনি গাছের চারা কেনেন। গ্রামের বাড়িতে তিনি গড়ে তুলেছেন ছোট্ট একটি নার্সারি; যার দেখাশুনা করেন তার মা রেনুকা সরকার ও ভাই সদানন্দ সরকার। নিজেদের মালিকানায় তেমন জমি না থাকলেও গাছ লাগানোর জন্য স্থানের অভাব হয়না আনন্দের। সড়কের ধারে, পতিত স্থানে, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি ব্যক্তি মালিকানার জমিতেও তিনি অনুমতি সাপেক্ষে গাছের চারা রোপণ করেন।
আনন্দ জানান, তিনি এমএম কলেজ, চাঁচড়া, মুজিব সড়ক, আশ্রম মোড়-চৌরাস্তা সড়ক, যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রম, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, পুলেরহাট, দড়াটানা, ঘোপ, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জামরুলতলা, বেজপাড়া, আরবপুর, ধর্মতলা, রাঙামাটি গ্যারেজ, শেখহাটি, বেজপাড়া বুনোপাড়া, শার্শার কায়বা ইউনিয়নের বাগআঁচড়া-গয়ড়া সড়ক, চালিতাবাড়িয়া- সোনাতন কাটি-মহিষা-বাইকোলা সড়ক। ছাবদার মাস্টার-হারুন ময়রা সড়ক, দিঘির বাগান -মহিষা সড়ক। বাইকোলা থেকে বিলপাড়া ও দীঘা সড়ক, রাঢ়ীপুকুর-সোনাতন কাটি সড়কসহ আরও বিভিন্নস্থানে তিনি গাছের চারা রোপণ ও বীজ বপন করেছেন। গ্রামে তার রোপণকৃত গাছের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। গ্রামের সড়কের ধারে তিনি খেজুর, দেবদারু, নিম, টগর, লেবু, লিচু, ডালিম, বেলি, জুঁই ও রঙ্গন গাছ রোপণ করেছেন। শহরের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সড়কে তার রোপণ করা গাছের মধ্যে রয়েছে গোলাপ, কাঁঠাল, নিম, জলপাই, বেলি, টগর, শিউলি, গন্ধরাজ, অর্জুন, বয়রা, আম, আমড়া, আমলকি, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কামিনী, পেয়ারা, জবা, করবী, বট, সফেদা, হাসনাহেনা, জাম, বেল, কাঠগোলাপ, গাব, আতা, অশোক, আশফল, লিচু, কদম, ইউক্যালিপটাসসহ অন্যান্য পাতাবাহারি গাছ। এসব গাছ তিনি উপহারও দেন উল্লেখ করে জানান বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজ উদ্যোগে উপহার হিসেবে গাছের চারা দিয়ে আসছেন আনন্দ। এ পর্যন্ত দু’ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা তিনি উপহার হিসেবে দিয়েছেন।
এমন কাজ কেন করেন-সেই প্রশ্নের উত্তরে আনন্দ জানান, ফুলে ফলে শোভিত অন্যরকম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন তিনি। আর্থিকসহ নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে তিনি তার এ কাজ চালিয়ে যেতে চান। আর্থিক সঙ্গতি থাকলে এ কার্যক্রম আরও বড় পরিসরে চালানোর পরিকল্পনা ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রাঙা প্রভাত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অধ্যক্ষ শরীফ আব্দুল্লাহ আল মাস্উদ বলেন, সামাজিক কাজের মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। আনন্দ নিজ অর্থায়নে আমাদের বিদ্যালয়েও অনেক গাছ রোপণ করেছেন। গাছপ্রেমী এ মানুষটার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা রয়েছে।
মুসলিমা আক্তার মৌ নামে একজন উদ্যোক্তা বলেন, যখন অনেকে নিজের স্বার্থে গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে তখন অন্যের স্বার্থে আনন্দ সরকার গাছ নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। মৌয়ের একটি প্রদর্শনী স্টলে আগত দর্শনার্থীদের আনন্দ গাছের চারা উপহার দিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি জানান এ ব্যতিক্রমী এবং সুন্দর উদ্যোগ তাকে উৎসাহিত করেছে।
যশোর সরকারি গণগ্রন্থাগারের রেফারেন্স অ্যাসিসট্যান্ট রাশেদুল ইসলাম বলেন, যশোর গণগ্রন্থাগারে আনন্দ সরকার অনেকগুলো গাছ রোপণ করেছেন। সেগুলোর নিয়মিত পরিচর্যাও করেন। গ্রন্থাগারে আগত পাঠকদের গাছলাগানোতে উৎসাহী করতে তিনি গাছ উপহার দেন। তার নীরব এ কাজ পরিবেশের জন্য যেমন বড় ভূমিকা রাখছে তেমনি একক প্রচেষ্টায় যে বড় কিছু করা সম্ভব তারও শিক্ষা দিচ্ছে।