Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য শাহ মোহসেন আউলিয়ার মাজার: ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক

শাহ মোহসেন আউলিয়ার মাজার: ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম:আনোয়ারা উপজেলার বটতলি গ্রামে অবস্থিত শাহ মোহসেন আউলিয়ার মাজারটি শুধুই একটি ধর্মীয় স্থান নয়; এটি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সুফি ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি স্থানীয় মানুষের প্রার্থনার কেন্দ্র, সামাজিক ঐক্যের প্রতীক এবং ইতিহাস-লোককথার মেলবন্ধনস্থল হয়ে আছে।

বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় ১২শ শতক থেকে, মূলত আরব, পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত সুফি সাধক ও বণিকদের হাত ধরে। চট্টগ্রাম, বিশেষ করে আনোয়ারা ও বাঁশখালী অঞ্চলে বহু সুফি সাধকের আগমন ঘটেছিল, যাঁদের কেউ কেউ দীর্ঘদিন বসবাস করে ধর্ম প্রচার করেছেন, আবার কেউ হয়ে উঠেছেন আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি।

শাহ মোহসেন আউলিয়ার জীবন নিয়ে লিখিত দলিল খুব কম থাকলেও স্থানীয় ইতিহাসবিদগণ ও মৌখিক ঐতিহ্যের অনুসারীরা মনে করেন, তিনি ১৫-১৬শ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে আসেন। তিনি ছিলেন হযরত বদর আউলিয়া বা শাহ শমসুদ্দিন বুখারীর সময়কার একজন সমসাময়িক সাধক, যাঁরা চট্টগ্রামে সুফি দর্শনের বীজ বপন করেন।

স্থানীয়দের মুখে মুখে ঘোরে, শাহ মোহসেন আউলিয়া অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। বলা হয়, তাঁর দোয়ায় বহু রোগী সুস্থ হয়ে উঠতেন, খরায় ফসল হতো, এমনকি নৌকা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে অনেকে। এখনও অনেকে তাঁর মাজারে এসে মানত করেন—বিশেষ করে সন্তান লাভ, অসুস্থতা নিরাময় ও বিপদমুক্তির জন্য।

একটি প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী, একবার বটতলিতে ভয়াবহ প্লাবন হলে গ্রামের মানুষ তাঁর দরগার চারপাশে আশ্রয় নেয় এবং পানির ধারা মাজারের চৌহদ্দি পর্যন্ত এসে থেমে যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী প্রজন্মের বিশ্বাস আরও গাঢ় হয়েছে।

মাজারটি খুব সরল নির্মাণশৈলীতে গড়া হলেও তার পবিত্রতা, নির্জন পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক আবেশে এটি ব্যতিক্রমী। মূল সমাধি সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং তার চারপাশে সাজানো থাকে দোয়ার ফিতা, ফুল ও ধূপ। প্রবেশমুখে একটি প্রাচীন গম্বুজ বিশিষ্ট গেট রয়েছে, যার গায়ে কিছু আরবি লিপি খোদাই করা, যদিও তা সময়ের সঙ্গে ক্ষয়ে গেছে।

প্রতি বছর আষাঢ় মাসে শাহ মোহসেন আউলিয়ার ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় হাজারো ভক্ত মাজার প্রাঙ্গণে মিলিত হন। রাতে চলে ক্বাওয়ালি, জিকির, মিলাদ ও মাজার শরিফ প্রদক্ষিণ। ওরস ঘিরে স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙা হয়; বসে অস্থায়ী দোকানপাট, মেলা, খেলনা ও খাদ্যপণ্যের বাজার।

শাহ মোহসেন আউলিয়ার মাজার একদিকে যেমন ধর্মীয় সাধনার প্রতীক, তেমনি এটি বটতলি ও আশপাশের জনগণের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন, আধ্যাত্মিক আশ্রয়স্থল ও সামাজিক সংহতির কেন্দ্রবিন্দু। এই মাজারের অস্তিত্ব প্রমাণ করে—ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাস কীভাবে যুগ যুগ ধরে একে অপরকে ধারণ করে চলে।

হযরত শাহ্‌ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ইয়েমেনে। তিনি তাঁর পিতা ও পরিবারের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরবর্তীতে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তাসাউফ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের পর তিনি পরিবারের সাথে তাঁর মামা, প্রখ্যাত পীর হযরত শাহ সূফী সৈয়দ বদর শাহ্‌ (রহ.)-এর সঙ্গে দিল্লি আসেন। কিছুদিন পর তাঁরা বাংলার রাজধানী গৌড়ে গমন করেন।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এবং হযরত বদর শাহ্‌ (রহ.) আনোয়ারার ইছাখালী গ্রামে অবতরণ করেন। কথিত আছে, তিনি এক পাথরকে বাহন বানিয়ে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এরপর ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং বহু মানুষ তাঁর মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত শাহ্‌ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) আনুমানিক ৯৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। প্রথমে তাঁকে ঝিউরী গ্রামে দাফন করা হলেও পরবর্তীতে বটতলীতে স্থানান্তর করা হয়। কথিত আছে, তিনি স্বপ্নযোগে একাধিক ব্যক্তিকে তাঁর রওজা স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। বর্তমানে তাঁর মাজারটি আনোয়ারা উপজেলার বটতলীতে অবস্থিত, যা বহু ভক্তের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।