বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের জেরে বিরাজমান সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৬ মে পর্যন্ত কন্টেইনারের ওপর প্রযোজ্য স্টোররেন্ট শতভাগ মওকুফ করেছে। তাতেও স্বস্তি নেই ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের। শিপিং কোম্পানির ডেমারেজও মওকুফের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। এ বিষয়ে শিপিং কোম্পানিগুলোর তেমন কোন সাড়া নেই।
শিপিং কোম্পানির ডেমারেজ মওকুফের ব্যাপারে হস্তপেক্ষপ চেয়ে আরও বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই দফায় দফায় অনুরোধ জানিয়েছে শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনকে। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। চট্টগ্রাম কাগজ ও সেলোফিন ব্যবসায়ী গ্রুপের জেনারেল সেক্রেটারি ও বিজিএপিএমইএ’র পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল ৬ মে নৌ পরিবহন সচিব বরাবরে এক পত্রে আবেদন জানিয়েছেন শিপিং কোম্পানির ডেমারেজ চার্জ মওকুফে হস্তক্ষেপ চেয়ে। ডিজি শিপিং-এর সার্কুলারটির কথাও এতে উল্লেখ করেন তিনি।
এক একটিতে ডেমারেজ দেড় দু’লাখ টাকা: সালাম
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন-বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম বললেন, আমাদের শিল্পকে ভয়াবহ সংকটে ফেলেছে শিপিং কোম্পানির ডেমারেজ চার্জ। চলমান সাধারণ ছুটির সময়ে এক একটি কন্টেইনারে ডেমারেজ চার্জ এসেছে দেড়লাখ থেকে দু’লাখ টাকা। দুর্বিপাকজনিত কারণে এত বড় অংকের ডেমারেজ কোন ব্যবসায়ী শিল্পপতির হিসাবে নেই। লকডাউন জনিত পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সমূদয় স্টোররেন্ট মওকুফ করে দিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশি ভারতেও বিভিন্ন শিপিং লাইন মওকুফ করে দিয়েছে কন্টেইনারের ডেমারেজ চার্জ।বিজিএমইএ তাদেরকে পত্র দিয়ে ডেমারেজ মওকুফ করার অনুরোধ করেছে। বিদেশি প্রিন্সিপালকে সেটা অবহিত করে জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন তারা। কিন্তু কোন কিছু হয়নি আজ পর্যন্ত।সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডেমারেজ মওকুফের সুপারিশ করে সার্কুলার জারি করেছে। কিন্তু শিপিং এজেন্টরা সেটাকে কোন গুরুত্ব দেয়নি। অথচ তারা, বিদেশিরা এদেশে ব্যবসা করছেন অবশ্যই এদেশের আইন কানুন প্রতিপালন করে। এদেশের সরকারি দপ্তর তাদেরকে এডভাইজরি দিয়েছে, সেটাকে তারা বিবেচনায় নেয়নি, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যে ডেমারেজ, সেটা কোন কোন ক্ষেত্রে কন্টেইনারের দামের চেয়ে বেশি। মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, তাদের উচিৎ আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা, আমাদের অস্তিত্ব না থাকলে শিপিং কোম্পানির ব্যবসাও থাকবে না। আগামীতে যে অর্থনৈতিক মন্দা তা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সব মহলের সমন্বিত সহযোগিতা।
ডেমারেজ দিয়ে পণ্য উৎপাদন ও বিপণন কঠিন: বশর
চিটাগাং মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক, বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধিকে বলেছেন, এখন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এ অবস্থার মধ্যে শিপিং কোম্পানির চড়া ডেমারেজ মোটেও প্রত্যাশিত নয়। দেশের সামগ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব অনিবার্য। বলেন, লকডাউনে শিল্প-কারখানা বন্ধ তাই কাঁচামাল এনে রাখার জায়গা নেই। ফিনিশড প্রোডাক্ট যদি হয় তাহলে সেটাও কোথায় নেবে, বিপণন বন্ধ। আন্তর্জাতিক কনভেনশন হচ্ছে এ রকম পরিস্থিতিতে প্রত্যেক সংস্থার তার অবস্থান অনুযায়ী ছাড় দেয়া। সে হিসেবে শিপিং এজেন্টদেরও এগিয়ে আসা উচিৎ। শতভাগ না হলেও ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনা করা প্রযোজন। কারণ, চলমান সংকট বিশ্বব্যাপী। এটা কোন এক দেশে বা এক স্থানে নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে তাও না। তাই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি, আশা করেন যে শিপিং কোম্পানিগুলো ডেমারেজ মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা করবেন। তা না হলে বিপুল পরিমাণ চার্জ ও ডেমারেজ দিয়ে পণ্য উৎপাদন এবং বিপণন করা কঠিন হবে। কোন প্রতিষ্ঠান বাজারে টিকতে পারবে না।
৭ দিন থেকে ১৪ দিন ‘ফ্রি টাইম’
জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামার পর ৭ দিন থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত ফ্রি টাইম থাকে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ডেলিভারি নেয়া হলে কোন চার্জ থাকে না। মাল খালাস করে শিপিং লাইনকে কন্টেইনার বুঝিয়ে দেয়া পর্যন্ত ডেমারেজ চার্জ। শিপিং লাইনগুলো তাদের নিজস্ব সুবিধা অনুসারে তা নির্ধারণ করে। সাধারণত
ফ্রি টাইম অতিক্রান্ত হওয়ার পর দৈনিক ৬ ডলার থেকে শুরু । ডেলিভারি নিতে বিলম্বে নির্দিষ্ট সময়সীমার পর ভিন্ন ভিন্ন হারে বৃদ্ধি পেতে পেতে তা দৈনিক ৪৮ ডলার পর্যন্ত প্রতি কন্টেইনারে।
সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর চলমান সাধারণ ছুটির সময়ে কন্টেইনারে কোনরূপ ডেমারেজ ও ডিটেনশন চার্জ আরোপ না করার সুপারিশ করে সম্প্রতি। আমদানি-রপ্তানি শিপমেন্টে কন্টেইনার ডিটেনশন, ডেমারেজ চার্জ আরোপ না করার সুপারিশ করে সার্কুলার জারি করেছেন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরেরমহাপরিচালক। করোনা পরিস্থিতি, সাধারণ ছুটি ইত্যাদি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জারি হয়েছে সার্কুলারটি।
অপরদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক ওয়ার্লড শিপিং কাউন্সিল ঐ সার্কুলারটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পত্র দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান বরাবরে। সংস্থার প্রধান নির্বাহী ও প্রেসিডেন্ট জন বাটলার পত্রে ডিজি শিপিংয়ের পত্রটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন এবং অনুরোধের সপক্ষে যৌক্তিক বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন।
শিপিং কোম্পানির ডেমারেজ চার্জ আরোপ এবং মওকুফ বিষয়ে বৃহৎ এক শিপিং কোম্পানির বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজনেসটুডে২৪ কে বলেন, আমরা সব সময় এ বিষয়ে ইতিবাচক, তবে জোর করে চাপানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে। নির্দিষ্ট ১৪ দিনের ফ্রি সময়ের মধ্যে ডেলিভারি নিলে তো ডেমারেজ নেই। সে সময়ের মধ্যে যদি যৌক্তিক কোন কারণে তা সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে আমাদেরকে জানালে অবশ্যিই বিবেচনায় নেবো। ক্যারিয়ার এবং আমদানিকারকের মধ্যে সেটা তো সব সময় হয়ে থাকে। বলেন, লকডাউনে ট্রান্সপোর্ট সমস্যা ছিল সেটা বিবেচনা করবো, কিন্তু ডকুমেন্ট সময় মত না পাওয়া বা স্ক্যানড ডকুমেন্টস কাস্টম হাউসের গ্রহণ না করার দায় কেন শিপিং কোম্পানি নেবে?
মওকুফের ক্ষমতা প্রিন্সিপালের: আহসানুল
‘ডেমারেজ মওকুফ করার ক্ষমতা প্রিন্সিপালের, সেটা আমাদের আওতাবহির্ভূত।’ এ কথা জানালেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আহসানুল হক চৌধুরী। বললেন, রপ্তানিকারক ও সাপ্লাইয়াররা বিদেশে ক্যারিয়ারের সাথে যোগাযোগ করে সমস্যাটি জানাতে পারে। এদিক থেকে আমরাও জানিয়েছি তাদের বিষয়টি। পৃথক পৃথকভাবে আবেদন করলে সেটা বিবেচনায় আসতে পারে। আবারও বললেন, এখানে শিপিং এজেন্টদের কিছুই করার নেই ডেমারেজ মওকুফের বিষয়ে।
লিজিং কোম্পানি কি মওকুফ করবে?
বাংলাদেশ কন্টেইনার শিপিং এসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন এ এস চৌধুরী বিজনেসটুডে২৪কে কন্টেইনারের ডেমারেজ চার্জ মওকুফের আহ্বান প্রসঙ্গে বলেন, কিভাবে তা মওকুফ হবে? লিজিং কোম্পানির কাছে থেকে কন্টেইনারগুলো ভাড়ায় নেয়া। লিজিং কোম্পানি তো অতিরিক্ত সময়ের ভাড়া মওকুফ করবে না। তাছাড়া, কন্টেইনারবোঝাই জাহাজগুলো বার্থ পাওয়ার জন্য বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি টাকা ডেমারেজ (অপেক্ষমাণ সব জাহাজ মিলিয়ে)গুণেছে। বললেন, শিপিং লাইনের প্রধান উদ্দেশ্য ভাড়া আদায়, পেনাল্টি নয়। ৭ দিন থেকে ১৫ দিনের ফ্রি টাইম থাকে সে সময়ের মধ্যে তো ডেলিভারি নেয় না, এমন কি ২৮ দিন, দেড় মাস, দু’মাস পরেও নেয়া হয় না।
ক্যাপ্টেন চৌধুরী বলেন, সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩০ শতাংশ পোর্ট ডিউজ মওকুফ করেছে। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান সংকট বিবেচনায় বাংলাদেশ কন্টেইনার শিপিং এসোসিয়েশনও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু ছাড়ের আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু এখনও হয়নি। সেটা হলে হয়তো শিপিং কোম্পানিগুলো কন্টেইনারে ‘ফ্রি টাইম’ বাড়িয়ে দিতে পারতো।