Home বিশেষ প্রতিবেদন শেয়ারবাজার: কিছু অপ্রিয় সত্য

শেয়ারবাজার: কিছু অপ্রিয় সত্য

জনমনে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, শেয়ার বাজার থেকে বিশাল টাকা আয় করা যায়। অনেকে আবার ভাবেন এখানে বিনিয়োগ করলে বুঝি রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া যায়। হ্যাঁ, এখানে বিনিয়োগ করে মোটা টাকা আয় করা সম্ভব, তবে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন যদি দেখেন তাহলে শেয়ার বাজারে না অংশ নেওয়াই ভালো। বাইরে থেকে শেয়ার বাজার ভীষণ সম্ভাবনাময় ও সুন্দর মনে হলেও এখানের অকথিত কিছু সত্য আছে যেগুলো না জানার জন্য কখনও কখনও নতুন বিনিয়োগকারীরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হন।

এখানে বিনিয়োগ বা ট্রেডিং করে সফল হয়েছেন এবং বিশাল সম্পদ বানিয়েছেন এ ধরনের অনেক গল্প শোনা যায় এবং এ ধরনের মানুষ সত্যিই আছেন। তাদের মধ্যে কারও কারও মুখে শেয়ার বাজারের সম্ভাবনাগুলোর সাথে সাথে এখানের অপ্রিয় সত্য গুলোর কথা কখনো কখনো শোনা গেলেও এই বাজারের সাথে যুক্ত অ্যানালিস্ট, দালাল এবং আরও অনেকে এই বাজারের কঠিন সত্যগুলো কখনোই বলেন না বা বলতে চান না।

এই নিবন্ধ থেকে শেয়ার বাজারের এইরকমই কিছু অপ্রিয় সত্যের ব্যাপারে জেনে নিন…

 শেয়ার বাজারে কিছুই গ্যারান্টেড নয় 

বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড হাউস বা ব্যাংকের লোকগুলো তাদের বিভিন্ন ফান্ড বা স্কিমে বিনিয়োগ করানোর জন্য কিংবা অনলাইনের বিভিন্ন শেয়ার মার্কেট সংক্রান্ত কোর্সের ট্রেনাররা কাস্টমার পাওয়ার জন্য কিংবা বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেল বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপের অ্যাডমিনরা নিজ স্বার্থে অনেক সময়ই শেয়ার বাজারে গ্যারান্টেড রিটার্নের কথা বলে থাকেন। কিন্তু আসলে এখানে গ্যারান্টেড কিছুই নয়।

কোনো শেয়ারের দাম বা কোনো ইনডেক্স কয়েক বছর বা কয়েক মাস বা কয়েক দিন এমনকি কয়েক মুহূর্ত পর আসলে কোথায় থাকবে কেউ জানেনা। সমস্ত ইনভেস্টার বা ট্রেডাররা এখানে যা কিছু করেন তা আসলে সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে, নিশ্চিত হয়ে না।

শেয়ার বাজারে সাধারণত বড় বড় ব্লুচিপ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা তুলনামূলক নিরাপদ বলে ধরা হয়। কিন্তু আসলে কোম্পানি যতই বড় হোক বা যতই ভালো হোক অনেক সময়ই লম্বা সময়ের জন্য ভালো রিটার্ন নাও দিতে পারে। যেভাবেই বা যত সাবধানেই বিনিয়োগ করা হোক না কেন এখানে বিনিয়োগের সাথে সব সময়ই কিছু ঝুঁকি তো থাকবেই।

 আসলে লোভ এবং ভয় শেয়ার বাজার চালনা করে

শেয়ারের দাম অনেক কারণেই ওঠানামা করে কিন্তু কারণ যাই হোক শেয়ারের দাম বেশি বা কম হওয়ার পিছনে থাকে শেয়ারহোল্ডারদের দুটো মানসিক অবস্থা বা আবেগ যথা, লোভ এবং ভয়।

বাজারে, দেশে, আন্তর্দেশীয় গতিবিধিতে এবং ইকোনোমিতে যখন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে এবং ঠিকঠাক চলে তখন ওভারঅল বেশিরভাগ কোম্পানির ব্যবসা বাড়ে এবং ফলস্বরূপ তাদের শেয়ারের দামও বাড়তে থাকে। আর শেয়ারের দাম বাড়ার ফলে যত লাভ বাড়তে থাকে শেয়ারহোল্ডারদের লোভও তার সাথে সাথে বাড়তে থাকে। আর যত লোভ বাড়ে তারা তত বেশি বেশি টাকা শেয়ার বাজারে ঢালতে থাকে আর তার ফলে শেয়ারের দাম এবং সাথে ইনডেক্স উত্তরোত্তর আরো বাড়তে থাকে। বাজারের মধ্যে এমন একটা মনোভাব তৈরি হয়, যেন এই উত্থানের শেষ নেই।

আবার একইভাবে যখন উল্টোটা হয় মানে যখন কিছু কিছু পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে তখন বাজারের উপর ইনভেস্টারদের বিশ্বাসে ভাটা পড়ে এবং সেল করা শুরু হয় আর শেয়ারের দাম পড়তে আরম্ভ করে। এভাবে চলতে চলতে বাজারে ভয় যত বাড়ে শেয়ারের দাম তত নামে আর তত সহ্যের বাঁধ ভাঙতে থাকে এবং তার সাথে সেলিং আরও বাড়তে থাকে ও বাজারে সবকিছুই আরও নীচে নামতে থাকে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাজার ওঠাপড়ার পিছনে আসল চালিকা শক্তি আসলে এখানে অংশগ্রহণকারীদের আবেগ।

তবে এখানে জিততে হলে লোভ বা ভয়, কোনো ক্ষেত্রেই ধরা দিলে কিন্তু চলবে না। নিজের বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে এই লোভ বা ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বা ট্রেডিং দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য পেতে এই দুটো আবেগের ওপরে নিয়ন্ত্রণ পাওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই।

কোম্পানির আর্থিক রিপোর্টে অনেক সময়েই কারচুপি করা হয়

শেয়ার বাজারের লিস্টেড কোম্পানিগুলো প্রত্যেক কোয়ার্টারে তাদের ব্যবসার ফলাফল অনুযায়ী একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট থেকেই কোম্পানিটার ব্যবসা এবং লাভ ক্রমাগত বাড়ছে না কমছে সেটা বুঝতে পারা যায়। স্বাভাবিকভাবেই একটার পর একটা রিপোর্টে ফল যত ভালো হয় কোম্পানিটার একটা ভালো ইমেজ তৈরি হয় এবং তার সাথে সাথে শেয়ারের দামও বাড়ে। এবং এতে কোম্পানির ব্যবসায় সুবিধা হয়।

কিন্তু কোনও কোম্পানি যখন বারংবার ভালো ফল করতে থাকে তখন সেই কোম্পানির প্রতি অনেক বেশি প্রত্যাশা তৈরি হয়। কিন্তু বাজার তো আর সব সময় একই বা অনুকূল থাকে না। তাই যখন কোম্পানিগুলো এ ধরনের উচ্চ প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তখন কোম্পানিগুলো অনেক সময় অনৈতিক উপায়ে কারচুপি করে তাদের রিপোর্ট সুবিধামতো বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে যাতে শেয়ারের দামে কোনরকম প্রভাব না পড়ে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের কারচুপি যখন ধরা পড়ে তখন কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যায় এবং স্বাভাবিকভাবে বাজে ফল প্রকাশ করলে শেয়ারের দামে যে প্রভাব পড়ত তার থেকে অনেক বেশি প্রভাব পড়ে আর এর আঁচটা সবথেকে বেশি আসে রিটেল ট্রেডার বা ইনভেস্টারদের উপর।

কুখ্যাত সত্যম স্ক্যাম এর একটা বড় উদাহরণ।

 শেয়ারের দাম অনেক সময় কৃত্রিম ভাবে বাড়ানো হয়

অনেক সময় বিভিন্ন কোম্পানির প্রোমোটাররা বা স্ক্যামাররা তাদের নিজ স্বার্থে বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে কৃত্রিমভাবে কিছু কিছু শেয়ারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। শেয়ারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে দেখে রিটেল ইনভেস্টাররাও লোভের বশবর্তী হয়ে ওইসব শেয়ার কিনতে আরম্ভ করেন। ফলস্বরূপ শেয়ারের দাম বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে।

তারপর যারা এটা শুরু করেছিল ঠিক সময় বুঝে তারা নিজেরা প্রফিট বুক করতে আরম্ভ করে এবং ক্ষতির মুখে পড়ে লোভের বশবর্তী হওয়া রিটেল ইনভেস্টাররা।

 ইনসাইডার ইনফরমেশন যাদের কাছে থাকে তারা এই আনফেয়ার অ্যাডভান্টেজ ব্যবহার করে লাভ করে

কোনো কোম্পানির প্রাইভেট ইনসাইডার ইনফরমেশন এর উপর ভিত্তি করে শেয়ার কেনা বেচা করা বা ইনসাইডার ট্রেডিং অবৈধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও গোচরে বা অগোচরে এ ধরনের ঘটনা শেয়ার বাজারে প্রায়শই হয় এবং এভাবে ইনসাইডাররা অনৈতিকভাবে যখন লাভ করে তার খেসারত অনেক সময় রিটেল ট্রেডার – ইনভেস্টারদের দিতে হয়।

 

 ইনডেক্সের বৃদ্ধি যেমনটা দেখানো হয় আসলে তেমনটা নয় 

যেকোনো দেশের শেয়ার বাজারের ফ্ল্যাগশিপ ইনডেক্সের বৃদ্ধি বা হ্রাস হওয়াকে সেই বাজারের সামগ্রিক বৃদ্ধি বা হ্রাস হিসেবে ধরা হয়। যেমন ভারতের ক্ষেত্রে নিফটি ৫০ ইনডেক্সের বিগত এক-দু দশক ধরে বৃদ্ধিটাকে বারবার সামনে তুলে ধরা হয়।

কিন্তু নিফটি ৫০-র এই বৃদ্ধি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ এই ইনডেক্সে যে সমস্ত কোম্পানির যত শতাংশ অন্তর্ভুক্ত থাকে সেটা কিন্তু সময়ে সময়ে ইনডেক্স রিব্যালেন্সিং-এর সময় পরিবর্তিত হয় এবং কখনো কখনো এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কোনো কোম্পানি বাদ পড়ে আবার কখনো নতুন কোম্পানিকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মানে যে সমস্ত কোম্পানি ভালো পারফরম্যান্স করে ইনডেক্সে তাদের পার্সেন্টেজ বাড়ানো হয় এবং যে সমস্ত কোম্পানি লম্বা সময়ের জন্য বাজে ফল করে তাদেরকে ইনডেক্স থেকে বাদ দেওয়া হয়। এভাবে ইনডেক্সের সামগ্রিক পারফরম্যান্স বজায় থাকে।

সুতরাং কুড়ি বছর আগে এই ইনডেক্সের মধ্যে যে যে কোম্পানি যত ভাগে ছিল আজ কিন্তু তার অনেকটাই বদলে গেছে। তাই কুড়ি বছরে নিফটি ৫০ যতটা বেড়েছে সেই বৃদ্ধিটা যেভাবে হয়েছে বলে মনে করা হয় আসলে কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়।

অন্যান্য দেশের ইনডেক্সের ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটে।

৯০% এরও বেশি লোক শেয়ার বাজারে লস করে

শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। শেয়ার বাজার অনেককেই ধনী করেছে ঠিকই কিন্তু এখানে যতজন অংশ নেন তার তুলনায় সফলদের সংখ্যাটা খুবই নগন্য।

জিরোধার প্রতিষ্ঠাতা নীতিন কামাথ একবার বলেছিলেন তাঁদের প্ল্যাটফর্মে 1% এরও কম ট্রেডার ব্যাংক এফডি-র থেকে বেশি আয় করতে সক্ষম হয়েছেন।

শেয়ার বাজার সাধারণত বড়লোককে আরো বড়লোক করে

বড় বড় ইনস্টিটিউশন গুলো এবং হাই নেট ওয়ার্থ ইন্ডিভিজুয়াল-রা মানে ধনকুবেররা তাদের বিশাল ক্যাপিটাল নিয়ে শেয়ার বাজারে টেকনিক্যাল ও কৌশলগত বেশ কিছু অ্যাডভান্টেজ যেমন পান তেমনি আবার ডিসকাউন্টেড ব্রোকারেজ, দ্রুততর প্রায়োরিটি অর্ডার এক্সিকিউশন এবং বিশেষ খবরের জোগান পান যেগুলো নগণ্য ক্যাপিটালের অধিকারী ছোট ছোট রিটেল ইনভেস্টাররা কখনোই পান না।

তাই এখানে সাধারণত বড়লোকরা আরো বড়লোক হতে থাকে আর বেশিরভাগ ছোট ছোট ইনভেস্টার – ট্রেডাররা কিছুই করে উঠতে পারেনা।

এটা বহুকাল আগেও ছিল এখনো আছে। ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটা এখন অনেক বেড়েছে। এরা নিজেদের শেয়ার বাজারের এক্সপার্ট বলে দাবি করেন এবং ইনভেস্টিং ও ট্রেডিং সম্পর্কিত একাধিক কোর্স অনলাইন এবং অফলাইনে করান।

কিন্তু এ ধরনের কোর্স যারা করান ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শেয়ারবাজারে কিছু করে উঠতে পারেননি। তারা বড়লোক হয়েছেন শেয়ার বাজার সম্পর্কিত কোর্স বিক্রি করে, ঠকিয়ে। এ ধরনের ট্রেনারদের থেকে খুব সাবধান!

তবে এটাও ঠিক, সব ট্রেনাররা এরকম ছদ্ম ‘এক্সপার্ট’ নন। শেয়ার বাজার সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হলে এরকমই সত্তিকারের এক্সপার্ট খুঁজে বের করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করা যেতে পারে ।

শেষ কথা

এত কিছু শোনার পর শেয়ার বাজার থেকে পিছিয়ে গেলেন নাকি? গোলাপ ফুলে যেমন কাঁটা থাকে তেমন সব ভালো জিনিসেই কিছু না কিছু গন্ডগোলও থাকে। এত কিছু সত্বেও আমি এখানে ইনভেস্টিং এবং ট্রেডিং করার পক্ষপাতী। তবে এখানের জলে ঝাঁপ দেওয়ার আগে জলের গভীরতা এবং সাঁতার দুটোই ভালো করে জেনে ও শিখে নেওয়াটা খুবই জরুরী।

সূত্র: গুপ্তধন.কম