Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য শোলা শিল্পের খুঁটিনাটি

শোলা শিল্পের খুঁটিনাটি

বাংলায় আজও কিছু হস্তশিল্পের প্রচলন রয়েছে, যার কদর এখনও কমে যায়নি। শোলাশিল্প হল তেমনই এক কারুশিল্প। শোলা দিয়ে নির্মিত নানা পণ্যসামগ্রীর বিপুল পরিমাণ চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বর্তমান। শোলাশিল্পীরা মূলত মালাকার নামে পরিচিত। তাঁদের অসাধারণ সূক্ষ্ম কারুকাজমন্ডিত শোলার টোপর, চালচিত্র, দেবদেবীর অঙ্গসজ্জার উপকরণ ইত্যাদি সামগ্রীর রমরমা রয়েছে ভীষণ। দেবী দূর্গার বিভিন্নরকম সাজের মধ্যে যে চিত্তাকর্ষক ‘ডাকের সাজ’, তাও কিন্তু আসলে এই শোলার কারিগরি। মূলত পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে এই শোলাশিল্পের কারিগরদের বসবাস। সেই উনবিংশ শতাব্দী থেকেই শোলা দ্বারা নির্মিত উপকরণ কিন্তু বাংলায় প্রচলিত। বহু মানুষের সংসার আজও এই শোলাশিল্পের ওপরেই নির্ভর করে চলছে।

প্রথমে এই শোলার উৎস সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। শোলা কী? এর উৎপত্তি কোথা থেকে? শোলা আসলে একটি জলজ ভেষজ উদ্ভিদ। মূলত ধানখেতে ও জলাভূমিতে এই শোলা গাছের জন্ম। তার বৈজ্ঞানিক নাম এস্কাইনোমেন অ্যাস্পেরা (Aeschynomene aspera)। এই গাছগুলি কান্ডসর্বস্ব গাছ। সেই নরম কান্ডের বাইরের আবরণটা হয় মেটে রঙের এবং ভিতরটা হয় সাদা। শোলা মূলত সাদা রঙেরই হয়ে থাকে। এই কান্ড থেকেই শোলার উৎপত্তি। সাধারণত ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা হয়ে থাকে এই গাছগুলি। এই উদ্ভিদ কিন্তু বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা এবং দাক্ষিণাত্যের জলাভূমিতে জন্মাতে দেখা যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের জলাভূমিতে কিন্তু দুরকম শোলা পাওয়া যায়, একটি হল, কাঠ শোলা, যা অপেক্ষাকৃত শক্ত হয় এবং আরেকরকম হল ভাট শোলা, যা অনেক হালকা ও নরম হয়।

শোলা সাদা রঙের হওয়ায় এটিকে শুদ্ধ ও পবিত্র বলে মনে করা হয়, সেইকারণেই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শোলা দ্বারা নির্মিত সামগ্রী ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

শোলাগাছ এবং মালাকার অর্থাৎ শোলাশিল্পীদের উদ্ভব নিয়ে একটি লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে। কথিত আছে যে, পার্বতীকে বিয়ে করতে যাওয়ার সময় শিবের ইচ্ছে হয়েছিল, তিনি একটি সাদা মুকুট মাথায় পরিধান করবেন। সেই ইচ্ছে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কাছে প্রকাশ করেন তিনি। কোন উপাদান দিয়ে সেই সাদা এবং আরামদায়ক মুকুট নির্মাণ করা যায়, তা নিয়ে বিশ্বকর্মা চিন্তিত হয়ে পড়লে শিবের ইচ্ছাতেই নাকি জলাশয়ে শোলাগাছের উদ্ভব হয়। কিন্তু বিশ্বকর্মা তো পাথর বা কাঠের মতো শক্ত সামগ্রী নিয়ে কাজে পারদর্শী, শোলার মতো নরম সামগ্রীকে কাজে লাগিয়ে সুচারু শিল্পনির্মাণের প্রক্রিয়া তো তাঁর অজানা। বিশ্বকর্মার এই অপারগতার ফলে, শিবের ইচ্ছেতেই জলাশয়তেই এক সুন্দর সুকুমার যুবার আবির্ভাব ঘটে, যে কিনা মালাকার নামে পরিচিত হয়। এই প্রচলিত কাহিনির কারণেই নাকি শোলাশিল্পীরা মালাকার নামে পরিচিত। এই লোককাহিনিটির কারণেই হয়তো, সূত্রধর ও কর্মকাররা বিশ্বকর্মার উপাসনা করলেও মালাকাররা ভগবান শিবের উপাসনা করে থাকেন।

একজন ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ হার্বার্ট হোপ রিসলি জানিয়েছেন, এই মালাকার বর্ণের মানুষেরা আসলে ‘নব সখা’দের অন্তর্ভুক্ত এবং এই মালাকারদের সঙ্গে মথুরার রাজা কংসের বংশের নাকি সরাসরি একটি যোগাযোগ রয়েছে। এই মালাকাররা অনেকেই দাবি করেন যে, তাঁরা আসলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মথুরা থেকে এসেছিলেন।

মালাকাররা একটা সময় পর্যন্ত বংশানুক্রমিকভাবে শোলাশিল্পের কাজ করতেন কিন্তু বর্তমানে সেই চিত্র খানিক পরিবর্তিত হয়েছে। বংশের উত্তরপুরুষের অনেকেই দেখা যায় সেই পরম্পরা মেনে এই পেশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে চাইছেন না।

পশ্চিমবঙ্গে মূলত বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বীরভূম, মালদা, কোচবিহার, হুগলির মতো জেলাগুলিতে এই শোলাশিল্পের ব্যাপক চর্চা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ঢাকা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, মাগুরা, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইত্যাদি নানা জায়গা শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।

শোলাশিল্পের জন্য প্রচুর যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। মূলত শোলা, ছুরি, কাঠ বা পাথর, আঠা এবং রঙ ব্যবহার করেই শিল্পীরা শোলার নানারকম সুচারু সামগ্রী তৈরি করে থাকেন। অবশ্য আরও নানারকম কারুকাজের জন্য শিল্পীরা কখনও কাচের টুকরো, চুমকি, পুঁতি ইত্যাদিও ব্যবহার করেন।

মুর্শিদাবাদের নবাবের আমলে বাংলায় সুপ্রচলিত যে হাতির দাঁতের শিল্পকলা, এই শোলাশিল্প কিন্তু ক্রমে ক্রমে তার জায়গাটিও নিয়ে নিয়েছিল৷ শোলা দিয়ে নির্মিত হতে শুরু করেছিল ময়ূর-আকৃতির নৌকা (নবাবী আমলে হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি হত বজরার মতো শো-পিসগুলি), পালকি, হাতি ইত্যাদি।

উনিশ শতকে এই বাংলাতেই ব্যাপকভাবে শোলার টুপির প্রচলন ছিল।

জেলে সম্প্রদায়ের মানুষও শোলা ব্যবহার করে থাকে মূলত মাছ ধরবার বড়শির ফাতনা তৈরির জন্য।

গৃহসজ্জার জন্য শোলার তৈরি নানারকম সামগ্রী ব্যবহার করে থাকে মানুষ। এছাড়া, দেবদেবীর মূর্তির অঙ্গসজ্জার জন্য শোলার তৈরি সাজ, চালচিত্র, মুকুট, মালা, শোলার কদমফুল এমনই নানাবিধ জিনিসের ব্যবহার এই শোলাশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজও। পূজার মন্ডপ নির্মাণের কাজেও শোলার বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। শোলা দিয়ে এমনকি বিভিন্ন মূর্তি ও আধুনিক শো-পিসও নির্মাণ করে থাকেন শিল্পীরা। বিবাহের সময় বর-কনের টোপর ও মুকুট ছাড়াও শোলার আরও নানারকম সামগ্রী লক্ষ করা যায়।

শোলাশিল্পের কথা বলতে হলে, বিশেষভাবে ‘ডাকের সাজ’-এর কথা উল্লেখ করতে হবে। মূলত দেবী দূর্গার অঙ্গসজ্জা হিসেবে সম্পূর্ণ শোলা দ্বারা নির্মিত এই ডাকের সাজ খুবই জনপ্রিয়। এই ডাকের সাজ কথাটির উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে কিছু কথা এখানে বলা যাক।

পলাশির যুদ্ধের পর শোভাবাজার রাজবাড়িতেই প্রথম দুর্গাপূজা হয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং সেখান থেকেই নাকি এই ডাকের সাজের প্রচলন। রুপোর তবকের পাত দিয়ে নির্মিত এই সজ্জা  ডাকের (Post) মাধ্যমে জার্মানি থেকে আসত।  ডাকে আসত বলে তার নাম হয়েছিল ‘ডাকের সাজ’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই অঙ্গসজ্জা আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপর থেকে শোলা দিয়ে তেমন সাজ নির্মিত হতে থাকে। তবে ‘ডাকের সাজ’ নামটি যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়িতে ডাকের সাজে নাকি আজও জার্মান তবক ব্যবহার করা হয়। আজও সেই ডাকের সাজ-এর সূক্ষ্ম কারিগরি, শুভ্র সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। তবে আক্ষেপের বিষয় আজ আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে, থিমপুজোর প্রতিযোগিতায় ডাকের সাজ প্রায় যেন বিলুপ্ত হতে বসেছে। কলকাতা শহরের কিছু পুরোনো বনেদি বাড়ির পুজোতে অবশ্য ঐতিহ্য মেনে আজও ডাকের সাজ দেখতে পাওয়া যায়।

শোলাশিল্পের জন্য বিখ্যাত কোচবিহারের একটি গ্রাম বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছে শোলাগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার সেইসঙ্গে বিশেষভাবে বলতে হয় পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের বনকাপাশি গ্রামের কথা। সেখানে প্রায় চারশো পরিবার রয়েছে, যারা এই শোলাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মধুমঙ্গল মালাকারের মতো আন্তর্জাতিক শোলাশিল্পীদের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। মূলত মুখশ নির্মাণের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন তিনি। লন্ডন মিউজিয়াম, ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অব আর্ট, বার্সেলোনা, এডিনবরা ইত্যাদি জায়গা মধুমঙ্গলের শোলার কাজ সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ২০২২ সালে প্রয়াত হয়েছেন এই আন্তর্জাতিক শোলাশিল্পী মধুমঙ্গল মালাকার।

তবে জলাশয় ক্রমে কমে আসায় শোলার আমদানি যেমন কমেছে, সেইসঙ্গে এই শিল্পটিরও অবস্থা হয়ে পড়েছে সঙ্গীন। তাছাড়া উৎসবের আধুনিকায়নের ফলে ঐতিহ্যশালী এই শিল্পের একপ্রকার অস্তিত্ব সংকটই দেখা দিয়েছে বলা চলে। তবু আজও বেশকিছু জায়গায় এই শিল্পের কদর লক্ষ করা যায়।