মনজু বিজয় চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল:এবার ঈদের ছুটির সাথে যুক্ত হয়েছে পহেলা বৈশাখের ছুটিও। তাই টানা ছুটিতে ঘুরে আসার জন্য ভ্রমণপিপাসুরা বেছে নিতে পারেন হাওড়-টিলা-চা বাগান বেষ্টিত শ্রীমঙ্গলকে।
শ্রীমঙ্গলের কথা এলেই ভ্রমণ পিপাসুদের মনের চিত্রপটে ভেসে উঠে সারি সারি চা বাগানের ছবি। শ্রীমঙ্গলের নিসর্গশোভা ৪৮টি চা বাগানের সতেজ সবুজ পাতার মায়া যে কোন ভ্রমণপিপাসু মনকে টানতে সক্ষম। উঁচু-নিচু পাহাড়, পাহাড়ের বুকজুড়ে চা বাগানের সারি, চারদিকে প্রকৃতির নজরকাড়া সৌন্দর্য, হাজার প্রজাতির গাছ-গাছালি, দিগন্তজোড়া হাওর আর নীল জলরাশিতে ঢেউয়ের ছন্দে প্রাণ জুড়িয়ে নিতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা আসেন চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গল শহরে চা, রাবার, লেবু, পান, আনারস ও মূল্যবান কাঠসহ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের বসবাসের কারণে শ্রীমঙ্গল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বেশ আকর্ষনীয়। তাইতো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের এই ঈদের ছুটিতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে শ্রীমঙ্গল।
শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করে দেখা যাবে এমন কয়েকটি দর্শনীয় স্থানগুলো:
চা কন্যা ভাষ্কর্য:
শ্রীমঙ্গলের সীমানায় এ ভাষ্কর্যটি আপনাকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে শ্রীমঙ্গল আসতে সাতগাঁও চা বাগানে সড়কের পাশেই আপনার চোখ আটকে যাবে এই শুভ্র ভাষ্কর্যে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকেও আপনি সিএনজি অটোরিকশা কিংবা টমটম নিয়েও যেতে পারেন। ভাড়া সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা। আর পথের দূরত্ব ১২-১৪ কিলোমিটার।
ন্যাশনাল পার্ক লাউয়াছড়ার:
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ন্যাশনাল পার্ক লাউয়াছড়ার অবস্থান। ১৯২০ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে পরিকল্পিত চাষাবাদ করে লাগানো চারাগাছগুলো এখন ঘন প্রাকৃতিক বনের আকার ধারণ করেছে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই পার্কে দেখা মেলে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পশুপাখি। ধীরে ধীরে পার্কটি এখন দেশের শিক্ষা, গবেষণা ও ইকো-ট্যুরিজম স্পট হয়ে উঠেছে। শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে অথবা বাসে করেও আপনি যেতে পারেন এ বনে। যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে দেখতে পাবেন সবুজ অরণ্য আর বিচিত্র সব পশুপাখি। তবে এসব প্রাণি দেখতে হলে বনের একটু গভীরে যেতে হবে আপনাকে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই):
ইনস্টিটিউটের চারদিকে বিচিত্র সব রঙের ফুলের সমাহার। এছাড়াও রয়েছে সারিবদ্ধ পাম, নাগলিঙ্গম, চামলসহ নানা জাতের বৃক্ষরাজির শোভা। হ্রদের জলে দেখতে পাবেন ফুটন্ত লাল পদ্মফুল। চা গবেষণাগার। আছে একটি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা। পুরো এলাকাটি আপনি দেখে নিতে পারেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে। মনোমুগ্ধকর এলাকাটি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এক কিলোমিটারের পথ। সর্বোচ্চ ৫০ টাকা ভাড়ায় রিকশা নিয়ে ১৫-২০ মিনিটে আপনি পৌঁছে যাবেন।
বাইক্কা বিল:
বাইক্কা বিল একটি অনন্য স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম এবং জলচর পাখির বিচরণভূমি। এর আয়তন ১০০ হেক্টর। বাংলাদেশের অন্যতম জলাশয় হাইল-হাওরে এর অবস্থান। ২০০৩ সালের ১ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে একটি স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। হাওরটি বর্ষায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে ১৩৩টি বিল ও বেশ ক’টি খালে খণ্ডিত হয়ে মোট ৪ হাজার হেক্টর এলাকায় সংকুচিত হয়ে পড়ে বিলটি। বাইক্কা বিলের প্রধান আকর্ষণ পাখি। বছরজুড়েই নানা প্রজাতির জলজ পাখির বিচরণে মুখরিত থাকে এ বিলটি। তবে শীত মৌসুমে প্রচুর পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য এখানে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। নয়নাভিরাম এ জলাভূমিতে যখন শাপলা, পদ্মসহ নানা প্রজাতির জলজ ফুল ফোটে, সেই দৃশ্যের কোন তুলনাই হয় না।
পশু-পাখি সেবাশ্রম:
এক সময়ের সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা এখন নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে বন্যপ্রাণি ফাউন্ডেশনের পশু-পাখি সেবাশ্রম। সিতেশ রঞ্জন দেবের এই সংগ্রহশালায় গিয়ে দেখতে পাবেন সাদা বাঘ, মেছো বাঘ, সোনালি বাঘ, ভাল্লুক, মায়া হরিণ, ময়না, অজগর সাপ, বানর, লজ্জাবতী বানর, সজারু, সোনালি কচ্ছপ, বনমোরগ, বন্য খরগোশ, উল্লুক, হরিণ, সাইবেরিয়ান ডাক, পাহাড়ি বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী।
ভাড়াউড়া লেক:
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেমস ফিনলের চা-বাগান। ভাড়াউড়ায় আছে একটি লেক যেখানে জলপদ্মের মেলা বসে। চা বাগানের বুকে এই লেকটির আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে কিন্তু কম নয়। এখানে রয়েছে বানর আর হনুমানের অবাধ বিচরণ। পাহাড়ের কাছাকাছি গেলেই দেখতে পাবেন বানরের দল। দু’একটা বানর আপনাকে দেখে ভেংচি কাটছে দেখে চমকে উঠবেননা আবার। তবে সতর্ক দৃষ্টিতে এগোতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন, আপনি এখন বানরের রাজ্যে। এছাড়াও এখানে শীতে দল বেঁধে আসে পরিযায়ী পাখি। যা পর্যটকদের চোখে মুগ্ধতা ছড়ায়।
নীলকন্ঠ চা কেবিন:
দেশের প্রথম দুই রঙ এর চায়ের আবিষ্কারক রমেশ রাম গৌড়ের নীলকন্ঠ চা কেবিনের অবস্থানও শ্রীমঙ্গলে। শহরতলীর রামনগর মনিপুরীপাড়ায় অবস্থিত এই চায়ের দোকানটিতে এখন দুই রঙ এর চা থেকে শুরু করে দশ রঙ এর চা-ও পাওয়া যায়। অনেক পর্যটকের কাছে এ এক বিস্ময়কর আকর্ষণ।
বধ্যভূমি ৭১:
শহরের ভানুগাছ সড়কে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই বধ্যভূমির অবস্থান।মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত এই বধ্যভূমি।
নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আবাস:
শ্রীমঙ্গলে খাসি, মনিপুরী, গারো, হাজং, টিপরা, রিকিয়াসন, বারাইক, সাঁওতালসহ প্রায় ৪০টি নৃগোষ্ঠীর আবাস। দেশের আর কোন উপজেলায় একসাথে আপনি এতোগুলো নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী খোঁজে পাবেন না। তাই বিচিত্রসব জাতি-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারায় অবগাহনে আপনাকে শ্রীমঙ্গল এর নাম উচ্চারণ করতেই হবে।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন:
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে কিংবা দেশের যেকোন স্থান থেকে রেলপথ অথবা সড়কপথে আপনি শ্রীমঙ্গল যেতে পারেন। শ্রীমঙ্গলে পর্যটকদের থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ রয়েছে। শ্রীমঙ্গলে রয়েছে পাঁচতারকা মানের গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ। এখানে ১৫ হাজার থেকে রুম ভাড়া শুরু। রুমভেদে ভাড়া নির্ধারিত হয়। এছাড়াও তিন তারকা মানের লেমন গার্ডেন রিসোর্ট, নভেম রিসোর্ট, বালিশিরা রিসোর্ট, গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্ট রয়েছে। এগুলোর ভাড়া রুমভেদে ৩ থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এ ছাড়া চা বোর্ডের একটি রিসোর্ট ও একটি গেস্ট হাউজ রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। চা বোর্ডের ওয়েবসাইটে ঢুকে এগুলোর রুম বুকিং দেওয়া যায়। অন্যদিকে জেলা পরিষদের দুটি ডাকবাংলো আছে, যেগুলোতে খুব স্বল্প খরচে রাতযাপন করা যায়। পাশাপাশি শহরের ভেতরে অনেকগুলো হোটেল আছে যেগুলোতে কম খরচে থাকা যায়। তবে একটা বিষয় মাথায় রেখে আপনাকে শ্রীমঙ্গলের ভ্রমণপ্ল্যান সাজাতে হবে- তা হলো আগেভাগে থাকার জায়গার বুকিং দেওয়া।