Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেখানে রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়ার চিঠি থেকে হরিণের শিং

যেখানে রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়ার চিঠি থেকে হরিণের শিং

আড়াইশো বছরের দে বংশের জমিদার বাড়ি। ছবি সংগৃহীত

শুভঙ্কর দে, কলকাতা: পূর্ব বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের নাম কমবেশি সকলেই জানেন। ল্যাংচা বিখ্যাত এই শক্তিগড়ের পাশেই রয়েছে বড়শুল গ্রাম। সেখানে রয়েছে আড়াইশো বছরের দে বংশের জমিদার বাড়ি। বিখ্যাত এই জমিদার পরিবারের বাড়িতে বর্তমানে গড়ে উঠেছে এক দুর্লভ ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা। শতাব্দী প্রাচীন এমন কিছু মূল্যবান জিনিস রয়েছে যা দেখলে দর্শক মাত্রই আশ্চর্য হবেন। এই দে বাড়ির জমিদারির পত্তন হয়েছিল নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র আমলে। উঁচু-উঁচু পিলার, কড়ি-বরগার ছাদ, নকশা করা বার্মা সেগুনের দরজা-জানালা, সিঁড়িগুলি শক্ত কাঠ দিয়ে বাঁধানো। এ বাড়ির শেষ জমিদার ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সদস্য রায় সাহেব গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দে। ইনিই বাড়ির প্রথম আইনজীবী ছিলেন। ১৯০৬ সালে তৎকালীন বড়লাট গভর্নর লর্ড উইলিন্ডন-এর কাছ থেকে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দে ‘রায় সাহেব’ উপাধি লাভ করেন। সংগ্রহশালায় ১৯৩৭ সালের ১৯ মে তারিখের একটি সার্টিফিকেট থেকে জানা যায় যে, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দে-এর ভাই হরেন্দ্রকৃষ্ণ দে ছিলেন তৎকালীন জেলার ইউনিউন বোর্ডের প্রেসিডেন্স।

বর্তমানে দে বাড়ির বংশধর শুভেন্দ্র মোহন দে-র ছেলে হিমাদ্রি শংকর দে গড়ে তুলেছেন ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা, নাম দিয়েছেন – শুভেন্দ্র মোহন দে ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা। বাড়ির দোতলাতে রয়েছে তাঁর তৈরি মূল্যবান সংগ্রহশালা। হিমাদ্রি শংকর দে তাঁর এলাকায় টুটুল নামেই পরিচিত। পেশায় ব্যবসায়ী। তবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণে একক প্রচেষ্টায় হিমাদ্রিবাবু এই সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন। ১৯৯৮ সালে দে-জমিদার বাড়ির প্রাচীন কিছু জিনিস হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেগুলি নিয়েই হিমাদ্রিবাবু প্রথম তৈরি করা শুরু করেন এই সংগ্রহশালা। এছাড়াও আরও অনেক জিনিস রয়েছে যা শতাব্দী প্রাচীন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষের ও জায়গার অংশ বিশেষ।

বর্তমানে দে বাড়ির বংশধর শুভেন্দ্র মোহন দে-র ছেলে হিমাদ্রি শংকর দে গড়ে তুলেছেন ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা, নাম দিয়েছেন – শুভেন্দ্র মোহন দে ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা। ১৯৯৮ সালে দে-জমিদার বাড়ির প্রাচীন কিছু জিনিস হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেগুলি নিয়েই হিমাদ্রিবাবু প্রথম তৈরি করা শুরু করেন এই সংগ্রহশালা।

সংগ্রহশালার ভিতরে ঢুকলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামগ্রী দেখে বিস্ময় জাগে। ঢুকেই প্রথমে সাজানো রয়েছে দুশো বছরের প্রাচীন তালপাতা, তুলোট পাতার পুঁথি। ২০০০ সালে তিনি এই পুঁথিগুলি সংগ্রহ করে আনেন কাটোয়ার পাটুলি থেকে। যেগুলি মূলত ধর্মগ্রন্থ বলেই বিবেচিত হয়েছে। ক্রমানুসারে সাজানো রয়েছে জমিদার বাড়ির বহু পুরোনো পাগড়ি, নায়েবি টুপি, বটুয়া, ব্রিটিশ আমলের ইংল্যান্ড থেকে আনা আতর, বেলজিয়ামের আয়না, কাচের গ্লাস। ব্রিটিশ আমলে পোস্ট অফিসে দেখা যেত এক ধরনের টেলিগ্রাফ মেশিন, সেই মেশিনও সংগ্রহশালায় রয়েছে। এছাড়া সেই সময়ের ছোটো হাতের ও বড়ো হাতের একসঙ্গে থাকা টাইপ রাইটিং মেশিন, স্পিরিট ল্যাম্প, দোয়াত, সুইডেনের তৈরি স্টেপলার, কলম (জরির কলম, পুঁথির কলম, মোষের শিং দিয়ে নির্মিত কলম) রয়েছে। আরও একটি কলম রয়েছে যেটির গায়ে লেখা আছে ১৯১৪ সাল, ২৭ জানুয়ারি। এই কলমের নিব সোনা দিয়ে তৈরি। কলমটি ব্যবহার করতেন সেই সময়ের জমিদার বাড়ির কর্তা।

সংগ্রহশালায় সব থেকে আশ্চর্য জিনিস রয়েছে ইংল্যান্ডে ছাপা এক ইঞ্চি/এক ইঞ্চি সাইজের অভিধান। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে প্রত্যেকটি অক্ষর স্পষ্টভাবে পড়া যায়। শব্দকোষটি বর্ধমান রাজপরিবারের সদস্য এস এস নন্দে দান করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় সাহেব গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দে উপহার পেয়েছিলেন অনেক কিছুই। তার মধ্যে আশ্চর্যের জিনিস হল একটি ক্ষুদ্র চাল। যার উপর ১০২টি অক্ষর লেখা আছে। এছাড়াও মুঘল আমল থেকে আধুনিক সময়ের বহু মুদ্রার সংগ্রহ রয়েছে হিমাদ্রিবাবুর সংগ্রহশালায়। সংগ্রহে রয়েছে এমন কিছু ঐতিহাসিক সম্পদ যা আজকের দিনে গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অন্যান্য অনুসন্ধিষ্ণু মানুষের কাছে মহা মূল্যবান হয়ে উঠবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় থেকে ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পোস্ট কার্ড, দলিল, ১৯৩২ সালের ম্যাপ, রানি ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত চিঠি, ষষ্ঠ এডওয়ার্ড-পঞ্চম জর্জ-এর আমলের ছোটো খাম, ১৯৪০ সালের ইউনিউন বোর্ডের হাতে লেখা ভোটার তালিকা, ১৯৪১ সালের পাশ বই, ১৯৩৬ সালের টেলিগ্রাফ, কংগ্রেস সভাপতির প্রথম প্রেসিডেন্স উমেশশ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৫) থেকে একেবারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (১৯৩৯) পর্যন্ত পরপর যতজন প্রেসিডেন্স ছিলেন তাঁদের নাম, ছবি ও সাল ক্রমানুসারে সাজানো রয়েছে।

ডাক টিকিটের বিশাল সংগ্রহ চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও সংগ্রহশালায় রয়েছে বর্ধমান মহারাজ আমলের একটি টাইপ মেশিন, সিগারেটের অদ্ভুত বাক্স, পিরিদানি, সের বাটখাড়া, বিরাট আকৃতির তালাচাবি, প্রাচীন ঘড়ি, হরিণের শিং, দুটি বহনযোগ্য গ্রামোফোন, গায়িকা হরিমতির রেকর্ড প্লেয়ার, ডোকরা শিল্পের নিদর্শন, জ্যোতির্বিদ্যার কিছু জিনিসপত্র, হ্যারিকেন, আমেরিকার দুটি ভাল্ব সিস্টেম রেডিও, চোখ ধোওয়া পাত্র, ছাদ পেটানো মুগুর, উই মারা ওষুধ, বক্স ক্যামেরা, শিলমোহর। কিছু পুরোনো ম্যাগাজিন ও বইপত্রও রয়েছে। যেমন- কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী রচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল’, শতবর্ষপ্রাচীন মহিলাদের দ্বারা প্রকাশিত পত্রিকা ‘অন্তঃপুর’ (১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সংখ্যা), ১৩১০ বঙ্গাব্দের ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’, ১৯০৩ সালের দাশরথির পাঁচালি, রানি ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত চিঠি, জমিদার বাড়িতে পাঠানো বর্ধমানের মহারাজ উদয়চাঁদ ও বিজয়চাঁদ মহতাবের স্বাক্ষরিত চিঠি। প্রাক-স্বাধীনতার সময়ের অনেক বিয়ের কার্ড রয়েছে যেখানে ছড়ার মাধ্যমে নিমন্ত্রণ করা হত। দুই আলমারি ভর্তি মূল্যবান গ্রন্থের সম্ভার, হিজ মাস্টার্স ভয়েজের ১৯৩২ সালের বাংলা গানের তালিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পরের দিনে প্রকাশিত বাংলা প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা। ১৯৩৫ সালে মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি একটি ফুলদানি যেটি হিমাদ্রিবাবুর ঠাকুমা নির্মলা সুন্দরী দেবীর হাতে তৈরি। এই শিল্প সামগ্রী বর্ধমান ইন্ডাসট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সিবিশনে প্রদর্শিত হয়ে ফার্স্ট ক্লাস সার্টিফিকেট পায়। সেই সার্টিফিকেট সংগ্রহালয়ে বাঁধানো রয়েছে।

এরকম এক ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা দেখতে এসেছেন অনেকেই — গান্ধী মিউজিয়ামের অধিকর্তা, এশিয়াটিক সোসাইটির কর্তাব্যক্তি প্রমুখ। তবুও এখনও এই সংগ্রহশালা পশ্চিমবঙ্গের সকল মানুষের কাছে পরিচিতিলাভ করে উঠতে পারেনি। পরিবারের আজকের প্রজন্ম জানাচ্ছেন, সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও প্রচারে এমন বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।

কীভাবে যাবেন:
পূর্বরেলের বর্ধমান-হাওড়া মেইন ও কর্ড লাইনের শক্তিগড় জংশন স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার পথ বড়শুল গ্রাম। যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই জমিদার বাড়ির রাস্তা চিনিয়ে দেবেন।