Home অন্যান্য সঞ্জয় গান্ধী মৃত্যু রহস্য

সঞ্জয় গান্ধী মৃত্যু রহস্য

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানান জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নানা সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নাথুরাম গডসের হাতে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর থেকে শুরু করে কংগ্রেসি রাজত্বে কখনও ইন্দিরা গান্ধী, কখনও রাজীব গান্ধী রহস্যজনকভাবেই দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছেন।

গান্ধী পরিবারেরই আরেক সদস্য ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধীও রহস্যজনকভাবে মারা যান। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক ও বিদ্বজ্জনের মতে এই বিমান দুর্ঘটনা আসলে পরিকল্পিত হত্যারই নামান্তর। কিন্তু আজও সঞ্জয় গান্ধী মৃত্যু রহস্য (Sanjay Gandhi Death Mystery) অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে।

ফিরোজ গান্ধী এবং ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় গান্ধী মায়ের মতই ভারতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন। রাজনৈতিক নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা ছিল বিশ্বজোড়া। শিখ দেহরক্ষীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুর পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজীব গান্ধী। কিন্তু তিনিও রহস্যজনকভাবে বোমা বিস্ফোরণে মারা যান।

রাজীব গান্ধীর ভাই সঞ্জয় ভারতের রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন অনেক তরুণ বয়সে। ১৯৮০ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ১৯৮০ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত তিনি উত্তরপ্রদেশের আমেঠী কেন্দ্র থেকে লোকসভার সদস্যও হয়েছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে মা ইন্দিরা গান্ধীর যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন সঞ্জয়। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেন, সেই সময় বকলমে দেশের শাসনভার ছিল তাঁরই হাতে। তিনি ইন্দিরার যোগ্য পরামর্শদাতা হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়। এমনকি তাঁর পাঁচ দফার উন্নয়ন প্রকল্পের কথা আজও ভারতবাসীর মনে আছে যার মধ্যে সবথেকে বিতর্কিত ছিল পরিবার পরিকল্পনা।

বলা হয় জরুরি অবস্থার সময় তাঁর নির্দেশেই নাকি বলপূর্বক নির্বীজন প্রক্রিয়া (Sterilization) চালানো হয়েছিল যথেচ্ছাচারে। এছাড়া তাঁর নির্দেশে সর্বভারতীয় বেতারে বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কিশোর কুমারের গান নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল কারণ কিশোর কুমার সেই সময় ভারতীয় যুব কংগ্রেসের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে অস্বীকার করেছিলেন। জামা মসজিদের সৌন্দর্যায়নের সঙ্গেও সঞ্জয় গান্ধীর কৃতিত্ব জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু নানা সময় বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন সঞ্জয়। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু ভারতের ইতিহাসে অন্যতম রহস্যজনক ঘটনা। শোনা যায় তাঁর বিমান দুর্ঘটনার আগেও নাকি তাঁকে তিন-তিনবার হত্যার প্রচেষ্টা হয়েছিল।

১৯৮০ সালের ২৩ জুন সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু হলেও তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালেরও আগে থেকে। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করার সময় সঞ্জয়কে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে জানানো হয় যে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকে একজন অজানা আততায়ী হত্যার পরিকল্পনা করেছে। যদিও সেটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যা প্রচেষ্টা। এই সংবাদ পেয়ে গান্ধী পালিয়ে যান এবং তার ফলে গুরুতর আহত হননি তিনি।

১৯৭৫ সালে ৩০-৩১ আগস্ট নাগাদ তাঁকে পরপর তিনবার গুলি করা হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি গুলিবিদ্ধ হননি। উত্তরপ্রদেশে  নির্বাচনী প্রচারের জন্য রাস্তায় ঘোরাঘুরি করার সময় একটি শক্তিশালী রাইফেল ব্যবহার করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে এই ঘটনায় ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ এবং মার্কিন দূতাবাস উভয় পক্ষেরই মনে হয়েছিল যে এই কাজে বহিরাগত কোনও বিপ্লবী শক্তির সংযোগ রয়েছে। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন নয়া দিল্লির সফদরজং বিমানবন্দরের কাছে তাঁর বিমানটি ভেঙে পড়ে। কী হয়েছিল সেদিন?

ভারতের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় বদল করেছিল সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু। তিনবার পাক খেয়ে সঞ্জয়ের বিমান আছড়ে পড়েছিল মাটিতে। ইন্দিরার সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে তাঁকে আর দেখা হল না ভারতবাসীর। তবে এই দুর্ঘটনার পিছনে লুকিয়ে ছিল অজানা কোনও এক ষড়যন্ত্র। সেদিন চালকের আসনে কুর্তা, পাজামা আর কোলাপুরি চপ্পল পড়ে বসেছিলেন সঞ্জয় গান্ধী স্বয়ং। সেভাবে বিমান চালানোর কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না।

সঞ্জয় গান্ধী মৃত্যু রহস্য এমনভাবে সাজানো যে প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনার সব দায় সঞ্জয় গান্ধীর উপরেই এসে পড়ে। কিন্তু প্রবীণ সাংবাদিক রশিদ কিদওয়াই-এর মতে স্পষ্টতই সঞ্জয় গান্ধী খুন হয়েছিলেন। পিটস এস ২ নামের সেই বিমানে ঠিক তার আগের দিনই সঞ্জয় গান্ধী নিজের স্ত্রী মানেকা গান্ধী এবং মা ইন্দিরাকে নিয়ে চড়েছেন, কিন্তু সেই সময় কোনও সমস্যা হয়নি। ফলে ঠিক তার পরের দিনই বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার যুক্তি কিদওয়াইয়ের কাছে অবাস্তব বলেই মনে হয়েছে।

দিল্লি ফ্লাইং ক্লাবের প্রশিক্ষক সুভাষ সাক্সেনার সঙ্গে সকাল ৭টা ২৮ মিনিটে সেই বিমানে আকাশে ওড়েন সঞ্জয় গান্ধী। মাত্র কয়েক মাস আগেই সেই বিশেষ বিমানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনানো হয়েছিল। আর সেদিনই দুর্ঘটনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তাঁর দেহ। নিকটবর্তী হাসপাতালের ডাক্তারেরা দীর্ঘ ৪ ঘন্টা পরিশ্রম করে তাঁর দেহাংশগুলিকে জোড়া লাগিয়েছিলেন।

মারুতি মোটরসের জন্য পাঞ্জাবে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে বহুবার বিতর্কের মুখে পড়েছেন সঞ্জয় গান্ধী আর তাছাড়া জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীকে পূর্ণভাবে পরামর্শদাতা হিসেবে সহায়তা করার জন্য ক্রমে ক্রমে তাঁর শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল অজান্তেই। সেদিনের সেই বিমান দুর্ঘটনার পিছনে এই শত্রুদেরই কারও হাত আছে কিনা তা আজও অজানা। আবার অনেকে বলেন ইন্দিরার সঙ্গে রাশিয়ার অধিক ঘনিষ্ঠতাকে পছন্দ না করা শত্রুদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।

সঞ্জয় নিজেও কখনও রুশ শক্তিকে ভাল চোখে দেখেননি, কিন্তু তিনি আবার মার্কিনিদের পক্ষেও ছিলেন না কখনও। কিন্তু তারপরেও যদি সত্যই সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পিছনে ষড়যন্ত্রের কারণ থেকে থাকে, তবে সেই কারণ আজও অজানাই থেকে গিয়েছে।