নাঈমা জান্নাত
আর কিছুদিন পর নতুন নুতন শিশুর পদচারণায় মুখর হবে সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল প্রাঙ্গণ। স্কুল কার্যক্রমের পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষকদের একটা বিষয়ে বেশ নজর রাখা প্রয়োজন। সেটা হলো বুলিং। আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য না হলেও উন্নত বিশ্বে শিশুদের সঠিক বিকাশের ক্ষেত্রে বুলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। এমনকি ঐসব দেশে প্রতিবছর ফ্রেব্রুয়ারির শেষ বুধবার এবং সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার তারা পালন করেন ‘এন্টি বুলিং ডে’। এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে তারা বুলিং বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।
বুলিং হলো এক ধরনের মৌখিক, মানসিক বা শরীরিক পীড়ন। ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কোন একজনকে বারবার বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখানো বা আক্রমণ করাই বুলিং। হতে পারে বিভিন্ন নামে ব্যাঙ্গ করা, বদনাম করা, লাথি মারা, বিভিন্ন ধরনের কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করা বা উত্ত্যক্ত করা। এমনকি অবহেলা বা এড়িয়ে চলে মানসিক চাপ দেয়াটাও এক ধরনের বুলিং। এক্ষেত্রে দুর্বল কাউকেই বেছে নেয় বুলিংকারী। স্কুল-কলেজ সহপাঠীদের মধ্যে এই বুলিং বিষয়টি ঘটে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে একজন, আবার অনেক ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন মিলে একজনকে বুলিং করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ন্যাশনাল সার্ভে অনুসারে, স্কুল জীবনে কোন না কোন সময়ে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীই বুলিংয়ের শিকার হয়। এর ফলে তাদের শিক্ষা জীবনে সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিক্ষার্থী এর শিকার হয়, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, ভীতসন্ত্রস্ততা, খিটখিটে মেজাজ এবং নিজেকে হেয় করে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়। এই বুলিং প্রতিরোধ না করলে সমাজে গঠনমূলক নেতৃত্ব ও সুনাগরিকের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই আপনার শিশুটি বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে কি-না বা কাউকে বুলিং করছে কি-না, দু’দিকেই সজাগ থাকা প্রয়োজন।
বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্বসিবল। এমন শ্লোগানের যুগে বন্ধু না থাকাটাই অস্বাভাবিক। বন্ধু থাকলে, তাদের সাথে আন্তরিকতা ও সখ্যতা এবং একে অন্যকে বোঝার ক্ষমতাও থাকবে। অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধু-বান্ধব না থাকলে আমরা ছেলে বা মেয়েটিকে অসামাজিক বলি। কিন্তু আমরা খতিয়ে দেখি না, অস্বাভাবিক এই বিষয়টি তার মধ্যে কিভাবে আসলো। সে কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কি-না! কোনভাবে সে তার স্কুল, কলেজ বা বন্ধু মহলে বুলিং বা অপদস্থের শিকার হয়েছে কি-না!
একইভাবে আপনার সন্তান অন্যকে স্কুলে বুলিং করছে কি-না, তা তার কিছু আচরণ পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারবেন। যেমন- বার বার সহিংসতায় জড়িয়ে পড়া, কথায় কথায় তর্কে জড়ানো, অন্যকে ছোট করা, স্কুলে বেশির ভাগ সময়ে নানা কারণে অভিযুক্ত হওয়া, তার কাছে নতুন নতুন জিনিসপত্র পাওয়া, কৃতকর্মের দায় স্বীকার না করা, অন্যকে অপদস্থ করে এমন বন্ধুবান্ধব থাকা, সবসময় জেতার নেশা এবং শীর্ষে থাকার চিন্তা-ভাবনা পোষণ করা। বাবা-মায়েরা মনে করেন, একজন আরেকজনকে মানসিক চাপে রাখার বিষয়টি বয়:সন্ধিকালে তাদের চরিত্র গঠন করে এবং এর মাধ্যমেই স্বাবলম্বী হয়ে বেড়ে ওঠে সে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু-কিশোর মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, তারা ধীরে ধীরে সমাজ বহির্ভূত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সে বিষণ্নতায় পড়ে এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতাকেই দোষারোপ করতে শুরু করে সে। এক পর্যায়ে স্কুল বা কলেজে যেতে তার অনীহা তৈরি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ভার্জিনিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র টিজিং ও বুলিংয়ের কারণে সেখানে ২৯ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।
কোন শিক্ষার্থী যাতে বুলিংয়ের শিকার না হয়, সেজন্য বাবা-মায়ের প্রথম দায়িত্ব হলো সন্তানের সাথে তার প্রাত্যহিক জীবন-যাপন নিয়ে খোলা মেলা কথা বলে সমস্যা চিহ্নিত করা, তাকে বুলিং সম্পর্কে অবহিত করা এবং মানসিক চাপ কমানোর সাথে সাথে বুলিং মোকাবেলায় সাহায্য করা। আপনার সন্তানের সব ধরনের কষ্ট লাঘবে কার্যকরী পদক্ষেপ নিন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞেরও পরামর্শ নিতে পারেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও যদি বুলিং বিরোধী কার্যক্রম হাতে নিই, তবে আশা করা যায়, আমাদের নতুন প্রজন্ম আরো সুন্দরভাবে বিকশিত হবে।
লেখক:সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর, সাজেদা ফাউন্ডেশন, চিকিত্সা মনোবিজ্ঞানে এমফিল গবেষক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়