Home First Lead শেয়ার কারসাজি চক্রের সঙ্গে সাকিবের নাম

শেয়ার কারসাজি চক্রের সঙ্গে সাকিবের নাম

দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত কারসাজিকারকের নাম মো. আবুল খায়ের, যিনি ‘হিরো’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। হিরোর বিরুদ্ধে গত দুই বছরে বেশ কিছু শেয়ারের কারসাজিতে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এজন্য বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানার মুখেও পড়েছেন হিরো ও তার পরিবারের সদস্যরা।

এই হিরোর সঙ্গে জড়িয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে শুরু করে নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছেন দেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। শেয়ার কারসাজির বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে সাকিব ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসছে।

পুঁজিবাজারে কারসাজির ঘটনায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, হিরো ও তার পরিবারের সদস্যরা যেসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছেন সেসব শেয়ারে একই সময়ে সাকিব বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। ২০২১ সালের ৫ মে থেকে চলতি বছর ১০ মার্চ পর্যন্ত হিরো গংয়ের চারটি কারসাজির ঘটনা তদন্তে সংশ্লিষ্ট শেয়ারগুলোতে সাকিবের বড় অঙ্কের বিনিয়োগের বিষয়টি উঠে এসেছে। শেয়ারগুলো হচ্ছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ফরচুন সুজ, ওয়ান ব্যাংক ও বিডিকম অনলাইন লিমিটেড। এসব শেয়ারের প্রতিটিতেই কারসাজি চলাকালে সাকিব নিজ নামের বিও হিসাবে অথবা তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংসের নামে বিপুল পরিমাণের শেয়ার লেনদেন করেছেন।

হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শেয়ার কেনাবেচার ব্রোকারেজ হাউজের মালিকানায় রয়েছেন সাকিব আল হাসান। মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাদিয়া হাসান; যে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ক্রিকেটার সাকিব। হিরোর স্ত্রী সাদিয়াও কারসাজির দায়ে অভিযুক্ত। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) শুভেচ্ছাদূত সাকিবের ব্রোকারেজ হাউজের নাম হচ্ছে মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড।

মূলত ২০২১ সাল থেকে পুঁজিবাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যায় সাকিবের। আর হিরোর উত্থান ২০২০ সালের জুন থেকে। সে সময় বীমার শেয়ার নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর একে একে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, জেনেক্স ইনফোসিস, ফরচুন সুজ, বিডিকম অনলাইন, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসসহ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েন হিরো ও তার পরিবার। এ সময় দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছাড়া তালিকাভুক্ত অন্তত তিনটি কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সঙ্গে নিয়ে কারসাজির জোট গড়ে তোলেন তিনি। এরপর সাকিবের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে হিরোর। ফরচুন গ্রুপকে নিয়ে বিপিএলে অংশগ্রহণের জন্য ফরচুন বরিশাল ফ্র্যাঞ্চাইজি নামে ক্রিকেট দল গঠন করা হয়, যেখানে সাকিব ছিলেন দলের ক্যাপ্টেন। আর ফরচুন বরিশাল ফ্র্যাঞ্চাইজি গঠনের নেপথ্যে ছিলেন হিরো।

চারটি শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের ৫ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ১৭২ শতাংশ বাড়ানো হয়। আর এ কারসাজির নেপথ্যে ছিলেন আবুল খায়ের হিরো, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ ও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেড। একই সময়ে এনসিসি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও তালিকাভুক্ত কোম্পানি সোনালী পেপার মিলসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুসসহ হিরোর জোটভুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিও ব্যাংকটির বিপুল পরিমাণের শেয়ার লেনদেন করেন। এ সময়ে সাকিব ব্যাংকটির ২৭ লাখ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে লেনদেনে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। অবশ্য ব্যাংকটির শেয়ার ক্রয়ে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকায় থাকলেও বিক্রির ক্ষেত্রে সাকিবের নাম ছিল না। এ শেয়ারে কারসাজি প্রমাণিত হওয়ায় হিরো, তার বোন কনিকা আফরোজ ও তাদের সহযোগীদের ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করে এসইসি।

২০২১ সালের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত সময়ে ফরচুন সুজ লিমিটেড নিয়ে ব্যাপক কারসাজি ঘটনা উদঘাটন করে ডিএসই। স্টক এক্সচেঞ্জটির তদন্ত প্রতিবেদনে এ শেয়ার কারসাজিতেও হিরো, তার স্ত্রী, বাবা, বোন ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। এ ছাড়া কারসাজি চলাকালে এনআরবি কমার্শিয়াল ও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এসএম তমাল পারভেজ, এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসও ফরচুন সুজের বিপুল পরিমাণের শেয়ার লেনদেন করেছে। উল্লিখিত সময়ে সাকিব দুটি বিও হিসাব ব্যবহার করে ফরচুন সুজের ৩৫ লাখেরও বেশি শেয়ার কেনেন। এ শেয়ারে কারসাজির মাধ্যমে হিরো গং ৩০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করে। আর কারসাজি প্রমাণিত হওয়ায় হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের দেড় কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

এ ঘটনায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কারসাজির আলোচিত ‘নায়ক’ আবুল খায়ের হিরোসহ চক্রের অন্য সবাইকে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। জরিমানার অর্থ আদায়ে বিএসইসি থেকে আদেশও জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির জন্য ও বাকি ৫৫ লাখ টাকা বিডিকমের শেয়ার কারসাজির জন্য জরিমানা করা হয়।

ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বরে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে ব্যাপক কারসাজি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা তুলে নিয়েছিলেন হিরো, তার পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা। গত বছর ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিনের কারসাজিতে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেনে ১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা মুনাফা তুলে নেওয়া হয়। নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে এ মুনাফা তুলে নেন তারা। আর কারসাজির জন্য হিরো তার নিজের, বাবার, স্ত্রীর ও বোনের এবং বন্ধুবান্ধব ও অনুসারীদের ১৪টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন। ওই সময়ে শেয়ারটির দর কারসাজির মাধ্যমে ৫৯ দশমিক ৬২ শতাংশ বাড়ানো হয়।

ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দামে বড় ধরনের উত্থানের সময় ব্যাংকটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচার সঙ্গে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল, যাদের মধ্যে আবুল খায়ের হিরো, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ; তার সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস পার্টনার্স; পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস, ফরচুন সুজ ও সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস; আবু নাসের দুলাল, খোরশেদ আলম এবং সানোয়ার খান। কারসাজি চলাকালে সাকিব ব্যাংকটির ৭৫ লাখ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে শীর্ষ লেনদেনের তালিকায় উঠে আসেন।

চলতি বছর ৭ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত কারসাজিতে বিডিকম অনলাইনের শেয়ারের দাম ২৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৪ টাকা ৩০ পয়সায় উন্নীত করতে প্রধান ভূমিকা রাখে হিরো ও তার স্ত্রী সাদিয়া ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, হিরোর বাবা আবুল কালাম, ডিআইটি কো-অপারেটিভ। এ ছাড়া ওই সময়ে শেয়ারটির শীর্ষ লেনদেনে ছিল ফরচুন সুজ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এর চেয়ারম্যান এসএম তমাল পারভেজসহ আরও কয়েকজন। এ সময়ে সাকিবের মালিকানাধীন মোনার্ক হোল্ডিংসও বিডিকম অনলাইনের ২৫ লাখ শেয়ার কেনে। শেয়ারটির দরবৃদ্ধিতে কারসাজি প্রমাণিত হওয়ায় ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও এর সহযোগীদের ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে এসইসি।

সূত্র: দেশ রূপান্তর