বাংলাদেশের জেলে ও মাছ গবেষকরা বলছেন যে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন নদীর মোহনায় মাছ ধরার সময় জেলেদের জালে বেশ বড় পরিমান সেইলফিশ আটকা পড়ছে।
এমনকি পদ্মা, মেঘনা এবং দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতেও প্রায়ই সেইলফিশ আটকা পড়ার খবর ঠাঁই পাচ্ছে গণমাধ্যমে।
কিন্তু কেন গভীর সমুদ্রের এই মাছ নদীর ভেতর কিংবা নদীর মোহনায় চলে আসছে, তা নিয়ে নানা ধরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে জেলে ও মৎস বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে।
ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশ (ইকোফিশ-২) অ্যাক্টিভিটির সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বিবিসি বাংলাকে জানান যে অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে একসাথে সতেরটি সেইলফিশ ধরা পড়ে পটুয়াখালীর একজন জেলের জালে।
আবার কক্সবাজারে অগাস্টের তৃতীয় সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই অনেকগুলো করে সেইলফিশ ঘাটে এনেছেন জেলেরা।
দেশের অন্যতম বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পটুয়াখালীর আলীপুর ও মহীপুর কেন্দ্রেও আসছে সেইলফিশ।
ওই এলাকায় নদীর মোহনা থেকেই বেশ কিছু সেইলফিশ ধরা পড়ার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জেলে মোহাম্মদ বাচ্চু।
“আমি কয়েকটা ধরছি গত মাসে। অন্যদের জালেও আটকা পড়ছে বেশ কিছু। এখন নদীতে রেগুলারই পাই একটা দুইটা,” টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছিলেন তিনি।
সেইলফিশ কী?
সেইলফিশকে বলা হয় সবচেয়ে দ্রুত গতির সামুদ্রিক মাছ। ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটতে পারে এই মাছ।
মাছটির ঠোঁট লম্বা এবং চোয়ালে রয়েছে তীক্ষ্ম দাঁত। এই দাঁত দিয়ে তারা অন্য প্রজাতির মাছ শিকার করে। এই মাছের শরীরের ওপরের অংশ গাঢ় নীল, নিচটা রূপালী রঙের এবং পাশের পাশের অংশ বাদামী।
দেখতে লম্বাকৃতির এই মাছটির পিঠের দিকে পাখার মতো আছে এবং এটি সাধারণত ১০ ফুটের বেশি লম্বা হয় না। আর এগুলোর ওজন সর্বোচ্চ ৯০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের প্রায় নয়শ মিটার পর্যন্ত গভীর দিয়ে মাছটি চলাচল করতে পারে।
এই মাছ যখন উত্তেজিত হয় কিংবা ভয় পায়, তখন পিঠের পাখাকে পানির ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। এ সময় তাদের পাখাগুলো দেখতে পাখির ডানার মতো মনে হয়।
সমুদ্রের মাছ নদীর মোহনায় বা নদীতে আসছে কেন
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার ও মেরিন অনুষদের শিক্ষক অন্তরা ঘোষ মনে করেন যে খাবারের সন্ধানেই সেইলফিশ নানা দিকে ছুটছে এবং এদের কিছু উপকূলের দিকে চলে আসছে বলেই জেলেদের জালে ধরা পড়ছে।
“সেইলফিশ গভীর সমুদ্রের মাছ। কিন্তু এ মাছটি ইলিশসহ এই প্রজাতির অন্যান্য মাছ খাবার হিসেবে খুব পছন্দ করে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
“অগাস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়ে ইলিশ জাতীয় মাছ স্বাদু পানির এলাকায় আসে। এদের ধাওয়া করতে করতেই কিছু সেইলফিশ নদীর মোহনা বা নদীতেও এসে পড়ছে। এগুলোই কিছু ধরা পড়ছে জেলেদের জালে।”
তবে হঠাৎ করে নদীর মোহনায় সেইলফিশের আগমন বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে ওয়ার্ল্ড ফিশের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি মনে করেন যে এই মাছগুলো যেখানে থাকে সেখানে তাদের কোন সমস্যা তৈরি হয়েছে।
“ভারতীয় গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে উপকূলে দূষণের প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে, যা মাছের জন্য অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করছে,” বলছিলেন তিনি।
অন্তরা ঘোষ অবশ্য এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, দূষণ একটি কারণ হলে সেইলফিশ আরও গভীর সমুদ্রে বা অন্য দিকে চলে যেতে পারতো। কিন্তু সেটি না করে তারা উপকূলের দিকে বা নদীতে আসছে, আর এর একমাত্র কারণ হলো খাদ্যের সন্ধান।
জেলে মোহাম্মদ বাচ্চু জানাচ্ছেন যে এই মাছ আগেও তাদের জালে আটকা পড়তো, তবে সংখ্যায় এতো বেশি নয়।
“সেইলফিশ কম বেশি আগেও জালে পেয়েছি,” বলছিলেন তিনি।
তবে সেইলফিশের এভাবে উপকূলে চলে আসা নিয়ে গবেষকদের মধ্যেই যে ভিন্নমত রয়েছে সেটা অন্তরা ঘোষ ও সাগরিকা স্মৃতি এই দুই গবেষকই স্বীকার করেন এবং সে কারণেই এ ব্যাপারে আরও গবেষণা চালানো দরকার বলে তারা মত দেন।
মানুষ কি সেইলফিশ খেতে পারে?
গত ২৭ বছর ধরে নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরেন মোহাম্মদ বাচ্চু। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে জেলেদের জালে সেইলফিশ নিয়মিত ধরা পড়লেও সেখানকার মানুষ এ মাছটি খেতে চায় না।
“আমরা বাজারে এনে পুরো মাছটি বিক্রি করি এবং সাধারণত এটি পরে উত্তরবঙ্গের দিকে চলে যায়। আবার কখনও কখনও কেটেও বিক্রি করে আমাদের অনেক জেলে,” বলছিলেন তিনি।
গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, সামুদ্রিক এই মাছটি মানুষের খাবার উপযোগী, তবে বাংলাদেশে সব জায়গার মানুষের মধ্যে এ ধরণের মাছ খাওয়ার প্রচলন নেই।
“বার-বি-কিউ করে খাওয়ার জন্য বা কিছু চায়নিজ রেস্তোঁরার জন্য অনেকে এই মাছ সংগ্রহ করেন। আবার অনেক জায়গায় টুনা ফিশের পরিবর্তেও এই মাছটি দেয়া হয়,” বলছিলেন তিনি।
-বিবিসি বাংলা