বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
ঢাকা: বিগত তিন দশকে ১১টির বেশি রাসায়নিক দুর্ঘটনায় তিন শতাধিক প্রাণহানি ও কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
সংস্থাটি মনে করে, নব্বইয়ের দশকে রাসায়নিক বা কেমিক্যালজনিত অগ্নিকাণ্ড কম ছিল, যা ২০১০ সালের পর বেড়েছে। রাসায়নিক বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনায় ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১টি ঘটনায় ৩৬০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার সিপিডির কার্যালয়ে ‘রাসায়নিক ও বিপজ্জনক পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শিল্প নিরাপত্তা : চট্টগ্রামের ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিমত জানায় সংস্থাটি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকি শুধু গার্মেন্টসেই সীমাবদ্ধ নয়, পুরো শিল্পেই ছড়িয়ে পড়ছে। সীতাকুণ্ডে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সাপ্লাই চেইনের অংশ। উৎপাদন চেইনে যে নিরাপত্তা সংকট সেটি উঠে এসেছে।
সিডিপি বলছে, দেশের যত কনটেইনার ডিপো রয়েছে তা দিয়ে মাত্র ১৯ শতাংশ কেমিক্যাল রপ্তানি হয়। আর বাকি ৮১ শতাংশই রপ্তানি হয় বন্দরগুলো দিয়ে। সে ক্ষেত্রে তারা পরামর্শ দিচ্ছে বন্দরগুলোর সক্ষমতার পাশাপাশি শ্রমিক নিরাপত্তা ও অগ্নিনিরাপত্তা বাড়ানোর কথা।
বাংলাদেশে ক্রমাগত শিল্পায়নের পাশাপাশি রাসায়নিকের ব্যবহারও বাড়ছে। বিভিন্ন কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে কেমিক্যালও ব্যবহৃত হচ্ছে। শিল্পায়নের এ উন্নতি রাসায়নিক দুর্ঘটনা বাড়াতে পারে। এমন অবস্থায় রাসায়নিক উৎপাদন, সংরক্ষণ ও পরিবহনে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রাসায়নিক দুর্ঘটনা তেমন একটা হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ ঘটনা বেশি হচ্ছে। দেশে যত শিল্পায়ন হবে এ ধরনের কেমিক্যালের ব্যবহারও বাড়বে। এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও বাড়ছে। এছাড়া বিএম দুর্ঘটনায় ১২ জন ফায়ার সার্ভিসকর্মী মারা গেলেন। তারা জানতেনই না এখানে এ ধরনের কেমিক্যাল মজুদ আছে, এটা শুধু তথ্যের ঘাটতিই নয়, তাদের প্রাণহানি শুধু নজরদারির অভাবেই।’
সংস্থাটি বলছে, ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ছোট, বড়, মাঝারি সব মিলিয়ে ২৫১টি কেমিক্যাল প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানিতে ৩৩ হাজার ৬৬০ জন কর্মী কাজ করছেন। এসব কারখানায় কর্মীদের যে ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা থাকার কথা সে ধরনের নিরাপত্তা নেই।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের রাসায়নিক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য সক্ষমতা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ডিপোও বন্দরগুলো জনবহুল স্থানে যেখানে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে জনমানুষেরও ক্ষতি হবে। বিএম ডিপোর কনটেইনার ধারণক্ষমতা ছিল ৬ হাজার ৩০০, যাতে ছিল ৪ হাজার ১১৩টি। যা মোট ধারণক্ষমতার ৬৫ শতাংশ। তবে শুধু ডিপোতেই নয়, ভবিষ্যতে আমদানি পর্যায়ে থাকা অবস্থাতেই দুর্ঘটনার শঙ্কা আরও বেশি।’
তিনি বলেন, ‘ডিপোগুলোর জন্য একটা সফটওয়্যার থাকা দরকার। যাতে কোনো কেমিক্যাল কোথায় আছে তা সহজে নিরূপণ করা যায়। আর ডিপোগুলো পোর্টের খুব কাছে, একটি দুর্ঘটনার কারণে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সেফটি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা উচিত। নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। আইন আছে কিন্তু পরিপালন হয় না।’
এ সময় জনবসতির বাইরে এমন রাসায়নিক হ্যান্ডেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, রাসায়নিক সম্পৃক্ত সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়, ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখা, রাসায়ানিক থাকা ডিপোকে রেড ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি।
বাংলাদেশে বিপজ্জনক কেমিক্যালের মধ্যে সব থেকে বেশি রপ্তানি হয় হাইড্রোজেন পারঅক্সাসাইড। সর্বশেষ ২০২১ সালে রপ্তানি হয়েছে ১৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার রাসায়নিক পণ্য। ৯৩ টাকা প্রতি ডলার মূল্য ধরে। তবে এ রাসায়নিক পণ্য রপ্তানি ও অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে যথাযথ সক্ষমতা নেই বলে মনে করছে সিপিডি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নব্বই দশকে রাসায়নিক বা কেমিক্যালজনিত অগ্নিকা- কম ছিল, যা ২০১০ সালের পর বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে অগ্নিনিরাপত্তা বাড়েনি।’
এ সময় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ের চাহিদার কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে শিল্পায়নের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশও এরই মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের অঞ্চল গড়ে তুলেছে। এগুলো শিল্পায়নের বড় ভূমিকা রাখবে। ক্রমান্বয়ে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাচ্ছি।’
বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ডিপোর ২৭টি কনটেইনারে বিপজ্জনক রাসায়নিক হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল, যার মধ্যে ১৫টি বিস্ফোরিত হয়েছে। রাসায়নিকের তথ্য না জানা এবং সেই ধরনের প্রস্তুতি না থাকায় সেখানে ১২ অগ্নিনির্বাপককর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।’