বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
সিলেট: টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সিলেট শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলাতে ক্রমাগত পানি বাড়ছে।
সোমবার (১৬ মে) বিকেল থেকে সুরমা নদীর পানি বাড়ায় আতঙ্কে নির্ঘুম মধ্যে রাত পার করেছেন সিলেট নগরীর অনেক মানুষ।
থেমে থেমে পানি বেড়ে সিলেটের বেশির ভাগ এলাকাই এখন ভাসছে বন্যায়। জেলা প্রশাসনের হিসাবে সিলেটের ৬টি উপজেলা বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া পানি উঠে গেছে নগরের বেশির ভাগ এলাকায়ও।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান জানান, বন্যাকবলিতদের জন্য নগরে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। নগরে শুকনো খাবার বিতরণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘প্লাবিত প্রতি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যাকবলিতদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তাও দেয়া হচ্ছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, সিলেটের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত পাঁচ দিনে ১২৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে সিলেটেও। ফলে দ্রুত বাড়ছে নদনদীর পানি।
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি অমলসীদ ও কানাইঘাট পয়েন্টে প্রায় ১৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর সিলেট সদরে ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানির তোড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যেই ভেঙে গেছে ২০টি নদীরক্ষা বাঁধ। এ ছাড়া কুশিয়ারা, সারি ও গোয়াইন নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবো সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, ‘পানি এত বেশি আসছে যে আমাদের বাঁধগুলো উপচে পড়ছে। কিছু কিছু জায়গায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি অতিরিক্ত থাকায় আমরা সংস্কারকাজও করতে পারছি না।’
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, সিলেটে বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
মঙ্গলবার দিনভর সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি মিনিটেই বাড়ছে পানি। নগরের অন্তত ২০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে এসব এলাকার সড়ক। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সরকারি অফিসেও পানি উঠে গেছে।
দুপুরে নগরের তালতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এই সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি জমে গেছে। পানির কারণে সড়কজুড়ে ছিল দীর্ঘ যানজট। পানি ঢুকে কারও কারও গাড়িতে দেখা দিয়েছে ত্রুটি। সড়কের মাঝখানে নিজের সিএনজি অটোরিকশাটিকে ধাক্কাধাক্কি করছিলেন চালক মইনুল হক। তিনি বলেন, ‘সায়লেন্সারে পানি ঢুকে গেছে। এখন আর স্টার্ট হচ্ছে না। ধাক্কা ছাড়া উপায় নাই।’
সোবহানীঘাট এলাকার গৃহিণী আমিনা বেগম বলেন, ‘ঘরের ভেতর পানি ঢুকেছে গতকালই। তখন থেকে বিছানার ওপর আছি। এখন মনে হচ্ছে, বিছানায়ও পানি উঠে যাবে।’ এ অবস্থায় ঘরে রান্না বন্ধ, এমনকি বাথরুমও ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে জানান আমিনা।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবার রাত থেকেই সিলেটে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। এখনও তা চলমান। বুধবার থেকেই সিলেটের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে শুরু করে। আর এখন বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
তলিয়ে গেছে জৈন্তাপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে পড়েছে। এই উপজেলার হেমু ভাটপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘পানি ঘরে ঢুকে গেছে। এখন মাচাংয়ের ওপর দিন কাটছে। বিশুদ্ধ পানি আর শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।’
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, জৈন্তাপুরে এবারের বন্যায় এ পর্যন্ত ৪০ একর বীজতলা পানির নিচে নিমজ্জিত এবং প্রায় ১০০ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে।
জৈন্তাপুরের ইউএনও আল-বশিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এর আগে পানিবন্দি মানুষের মাঝে ত্রাণ ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। একই সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও বিতরণ করা হচ্ছে। আমরা উপজেলা প্রশাসন পানিবন্দি মানুষের সহায়তায় সার্বক্ষণিক কাজ করতে প্রস্তুত আছি।’
বন্যায় জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল, মানিকপুর, কাজলসার, বিরশ্রী ইউনিয়নের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। বারহাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ জানান- তার ইউনিয়নের নোয়াগ্রাম, উত্তর খিলোগ্রাম, চকবারাকুলি, শরীফাবাদ, শাহগলী বাজার ও কচুয়া এলাকা সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে তলিয়ে গেছে।
বিরশ্রী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার জানান, সুপ্রাকান্দি ও বড়চালিয়া গ্রামের বেড়িবাঁধ যেকোনো সময় ভেঙে পুরো ইউনিয়ন তলিয়ে যেতে পারে।
বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জকিগঞ্জের যোগাযোগব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে।
এ ছাড়া বন্যায় তলিয়ে গেছে কানাইঘাট, সদর, গোয়াইনঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকাই। এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়কই তলিয়ে গেছে। পানি উঠে গেছে কানাইঘাট থানায়ও।
ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় নিজেদের পাশাপাশি গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।
গোয়াইনঘাটের রাধানগর এলাকার বাসিন্দা সাহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা না হয় কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু গরুগুলোকে কী করব?’