ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী অগ্নিকন্যা সুনীতি চৌধুরী। তিনিই ছিলেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিপ্লবী শান্তি ঘোষের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করেন সুনীতি চৌধুরী। এর ফলে তাঁর দশ বছরের কারাদণ্ডের সাজা ঘোষিত হয়, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের আপোষ-মীমাংসার ফলে সাত বছর হিজলি জেলে কাটিয়েই মুক্তি পান সুনীতি চৌধুরী। ভারতের সক্রিয় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন তিনি। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে স্বাধীন ভারতে এমবিবিএস পাশ করে ডাক্তারি শুরু করেছিলেন সুনীতি।
১৯১৭ সালের ২২ মে কুমিল্লার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে সুনীতি চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা উমাচরণ চৌধুরী এবং তাঁর মায়ের নাম সুরসুন্দরী চৌধুরী। উমাচরণ চৌধুরীর আদি নিবাস ছিল ত্রিপুরার নবীনগর থানার ইব্রাহিমপুরে। পেশায় সুনীতির বাবা ছিলেন একজন সরকারি চাকুরে। তাঁর দুই বড় ভাই কলেজে পড়ার সময়েই ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং তাই পারিবারিকভাবেই এক বৈপ্লবিক আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন সুনীতি। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে প্রদ্যোত কুমার ঘোষের সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর।
কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা চৌধুরী বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন সুনীতি চৌধুরী। সেই সময় কুমিল্লার আরেক বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাছাড়া তাঁর স্কুলের এক বড় দিদি প্রফুল্ল নলিনী ব্রহ্মের দ্বারাও তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শেই সুনীতি চৌধুরী ব্রিটিশ কর্তৃক নিষিদ্ধ বইপত্র এবং বিপ্লবী সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।স্বামী বিবেকানন্দের মাতৃভূমির জন্য জীবনদানের মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। প্রফুল্ল নলিনী ব্রহ্মের সঙ্গে সুনীতি চৌধুরী ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দেন। একইসঙ্গে ত্রিপুরা জেলা ছাত্রী সংঘেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এই সংগঠনের মহিলা শাখাটি যুগান্তর দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। তাঁকে ঐ সংঘের জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মেজর পদে নিযুক্ত করা হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসা যখন শহরে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন, সেই সময় তাঁকে স্বাগত জানাতে মেয়েদের কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩১ সালের ৬ মে ত্রিপুরা জেলা ছাত্রী সংঘের বার্ষিক সম্মেলনে সুনীতি চৌধুরী মহিলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচিত হন। এই সময় মীরা দেবী নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই এই সংঘে ‘আগ্নেয়াস্ত্র রক্ষক’ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি এবং মহিলা সদস্যদের লাঠিখেলা, তলোয়ার চালনা ও ছোরা চালনার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান। সম্মেলনের শেষে নেতাজি যখন সংঘের মেয়েদের সঙ্গে দেখা করছিলেন, প্রফুল্ল নলিনী ব্রহ্ম তাঁকে সশস্ত্র সংগ্রামে সরাসরি মহিলাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর উত্তরে নেতাজি তাঁকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে তাঁর সামনের সারিতে সমস্ত মহিলাদের দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ছাত্রী সংঘ যখন ইতিমধ্যেই বয়সে নবীন ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, সেই সময় তাঁদের প্রশিক্ষণেই সংঘের বুদ্ধিমান ও সাহসী ছাত্রীরা অস্ত্র, গোলা-বারুদ, কাগজপত্র এবং টাকা-পয়সা বিতরণ ও সংগ্রহের ব্যাপারে প্রশিক্ষিত হয়েছিল। যদিও সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ এবং প্রফুল্ল নলিনীর সঙ্গে একত্রে আরও অতিরিক্ত দায়িত্ব চাইছিলেন। তাঁরা চাইছিলেন সংঘের মেয়েরা যাতে পুরুষদের সমান অধিকার ও দায়িত্ব পান। মেয়েদের অস্ত্রধারণ নিয়ে যখন সংঘের পুরুষ সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই সময় তাঁদের সকলের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে তীব্রভাবে জবাব দিয়েছিলেন সুনীতি চৌধুরী এবং জানিয়েছিলেন যে বাস্তব পরিস্থিতিতে যদি তাঁদের অস্ত্র ধরার অধিকার নাই থাকে, তাহলে এত আয়োজনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার মানেই থাকে না। পলাতক তথা ফেরার বিপ্লবীদের মধ্য অন্যতম বীরেন ভট্টাচার্য ছাত্রী সংঘের মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেন এবং শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী এবং প্রফুল্ল নলিনী ব্রহ্মকে অসম সাহসী বলে ঘোষণা করেন তিনি। ত্রিপুরা স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের সভাপতি অখিলচন্দ্র নন্দীর তত্ত্বাবধানে তাঁদের প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। স্কুল পালিয়ে শহর থেকে দূরে ময়নামতী পার্বত্য অঞ্চলে ঘন জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র চালানো অভ্যাস করতেন। শুধু চিহ্নিত লক্ষ্যকে গুলির আঘাতে ধরাশায়ী করাই তাঁদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল না, বরং একইসঙ্গে বন্দুকে ধাক্কা সহ্য করা ও তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা শেখাও তাঁদের কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুনীতি চৌধুরীর তর্জনী সঠিকভাবে বন্দুকের ট্রিগারে পৌঁছাত না, কিন্তু তিনি কিছুতেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী ছিলেন না। তিনি তর্জনীর পরিবর্তে অনামিকা ব্যবহার করে বেলজিয়ামে তৈরি ছোট্ট পিস্তলের সাহায্যে গুলি করা আয়ত্ত করে ফেলেন খুব সহজেই।
সেকালে কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন চার্লস জিওফ্রে বাকল্যান্ড স্টিভেন্স। বিপ্লবীদের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন তিনিই। সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কোনো কিছুই তাঁর অসাধ্য ছিল না। প্রতিটি অহিংস ভারতীয়কে নির্যাতন ও কারাগারে নিক্ষেপ করতে শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল ঠিক দশটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সের বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামে আর সেখান থেকে নেমে আসেন দুই কিশোরী। শাড়ির উপরে তাঁরা দুজনেই শীত কাটাতে চাপা দিয়েছিলেন সিল্কের চাদর। গাড়ির কোচম্যান খুব তাড়াতাড়িই সরে যায় সেই জায়গা থেকে। অর্ডারলির মাধ্যমে একটি ইন্টারভিউ স্লিপ পাঠায় তাঁরা এবং সাব-ডিভিশনাল অফিসার নেপাল সেনের সঙ্গে বেরিয়ে আসেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স। তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মীরা দেবী এবং ইলা সেনের স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র তাঁকে দেন সই করার জন্য যেখানে একটি সাঁতারের উপযোগী সুইমিং ক্লাব খোলার আবেদনের কথাই লেখা ছিল। গুলি করার সুযোগ খুঁজছিলেন দুজনেই, শান্তি ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরী। সুনীতির বয়স তখন মাত্র ১৬। যখনই তিনি চিঠিটি সই করার জন্য তাঁর অফিসে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন সেইমাত্র শালের ভিতরে লুকিয়ে রাখা পিস্তলের সাহায্যে দুজনে পরপর দুটি গুলিতে হত্যা করেন ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে। গুলির শব্দ শুনেই ছুটে আসেন নেপাল সেন এবং হাতে-নাতে ধরা পড়েন সুনীতি এবং শান্তি। নিজেদের বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করেননি তাঁরা। আসন্ন অত্যাচারের জন্য যেন সুনীতি চৌধুরী আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। আঙুলের ডগায় পিন ফোটানো থেকে শুরু করে তল্লাশির নামে শ্লীলতাহানি পর্যন্ত সহ্য করে গিয়েছেন সুনীতি চৌধুরী। খুব দ্রুত দিকে দিকে এই খবর রাষ্ট্র হয়ে যায়। বিপ্লবীরা সুনীতির ছবি দিয়ে একটি পুস্তিকা ছেপে বিলি করতে থাকে তাঁর সাহসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। সেই পুস্তিকায় তাঁর ছবির নীচে লেখা ছিল একটিই বাক্য – ‘রক্তে আমার লেগেছে আজ সর্বনাশের নেশা’।
স্থানীয় ব্রিটিশ কারাগারে তাঁদের বন্দি করা হয়। বহু নির্যাতন ও অত্যাচার সত্ত্বেও বিচারের দিনগুলিতে সুনীতি চৌধুরী শান্তি বজায় রেখেছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন শহীদের মত মৃত্যু হবে তাঁদের। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার আদালতে যখন তাঁদের উপস্থিত করা হয়, নাবালক হওয়ার কারণে ফাঁসির বদলে তাঁদের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। একটি সাক্ষাৎকারে সেই সময় তিনি বলেছিলেন যে এই রকম ঘোড়ার আস্তাবলে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক বেশি গর্বের। তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি হিসেবে সুনিতি চৌধুরীকে রাখা হয়েছিল হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে। তাঁর এই সরকার-বিরোধী কাজকর্মের জন্য তাঁর বাবার পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়, এমনকি তাঁর দুই বড় দাদাকে বিনা বিচারে জেলে বন্দি করা হয়। গান্ধীজি ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে আপোষ-মীমাংসার ফলে সাত বছর কারাবাসের পরে ১৯৩৯ সালে সুনীতি চৌধুরী কারাগার থেকে মুক্তি পান। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন এবং এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করে ডাক্তারি করা শুরু করেন।
১৯৮৮সালের ১২ জানুয়ারি সুনীতি চৌধুরীর মৃত্যু হয়।