- ২০৪৫ সাল নাগাদ প্রবালশূন্য হয়ে পড়ার আশংকা
- সৈকতে মোটর যান ও আলোকায়ন নিষিদ্ধ
- রাত যাপনের সুযোগ দেয়া হবে সর্বোচ্চ ৫শ’ জন
সালেহ নোমান
সেন্টমার্টিন হতে: পর্যটকদের অবাধ যাতায়াতে লাগাম টেনে বিশেষ সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত করা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট বঙ্গোপসাগরের সেন্টমার্টিন দ্বীপকে।
অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে প্রতিবেশগতভাবে চরম হুমকিতে থাকা দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি রক্ষার জন্য সেখানে বাণিজ্যিক পর্যটন নিরুৎসাহিত করে, শুধুমাত্র প্রকৃতি প্রেমী ও এই সংক্রান্ত গবেষণা এবং পরীক্ষা– নিরীক্ষার সুযোগ রাখা হবে।
প্রবাল, বিরল প্রজাতির কাছিম, মূল্যবান সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল সেন্টমার্টিন–এ বছরে ১০ লাখের মত পর্যটক যান। কোন ধরনের ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্রাণ বৈচিত্রে ভরপুর আট বর্গকিলোমিটারের ছোট দ্বীপটি ২০৪৫ সাল নাগাদ প্রবালশূন্য হয় পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে দেশ বিদেশের নানা গবেষণায় ।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব ( পর্যটন ) ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, দ্বীপটিতে আগামী বছরের শুরু থেকে দৈনিক সর্বোচ্চ ১২শ’ থেকে ১৫ শ’ পর্যটক ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। আর রাত্রি যাপনের সুযোগ পাবেন মাত্র ৪শ’ থেকে ৫শ’ জন।
”একটি অ্যাপস প্রস্তুত করা হচ্ছে, এই এ্যাপসের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হবে সেখানে যাওয়ার জন্য, কারা যেতে পারবেন সেটা। ক্যাটাগরি করা থাকবে। শর্ত পূরণ হলেই কেবল অনুমতি মিলবে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য। তাও সংখ্যা নিদির্ষ্ট করা থাকবে। এর বাইরে অনুমোদন মিলবেনা,” জানান তিনি।
মল্লিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ”সেন্টমার্টিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি ইতোমধ্যে দু’টি সভা করেছে। আরো একটি সভা সহসা অনুষ্ঠিত হবে। বিগত সভাগুলোতে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।”
আগামী বছরের শুরুতে নতুন সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরের প্রচেষ্টা চলছে উল্লেখ করে আরো বলেন, ”মোটামুটি সবগুলো সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হচ্ছে সেন্টমার্টিনসে বাণিজ্যিক পর্যটন নিরুৎসাহিত করা । শুধুমাত্র প্রকৃতি– প্রেমীরা সেখানে যেতে পারবেন এবং গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজে নিয়োজিতদের অগ্রাধিকার থাকবে।”
১৯৯৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্টমার্টিনকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে। ২০১৬ সালে দ্বীপের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষন ও পরিবেশ–বান্ধব পর্যটনের একটি প্রকল্পও নেয়া হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত সেন্টমার্টিনসের বিষয়ে আটটি মন্ত্রনালয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় আন্ত:মন্ত্রনালয় কমিটি । বলা যায়, কমিটির হাতে সেন্টমার্টিনের বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত অর্পণ করা হয়েছে।
সেন্টমার্টিন বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক সোলাইমান হায়দার জানিয়েছেন, দ্বীপের দক্ষিণ অংশের ছেড়াদ্বীপে ইতোমধ্যে মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বর্তমান পর্যটন মওসুম শুরুতে সেন্টমার্টিনের সৈকতে মোটর যান ও আলোকায়ন নিষিদ্ধ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কোষ্টগার্ডকে, উল্লেখ করেন তিনি।
পরিবেশ দপ্তরের এই প্রকল্পের অধীনে সেখানকার কয়েক শ ‘বাসিন্দাকে সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভ্রমণকারিদের বর্জ্যের কারণে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিষয়ে আরো বেশি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাপত্র বলছে, সেন্ট মার্টিনে ১৯৮০ সালে ১৪১ প্রজাতির প্রবাল ছিল। দ্বীপসংলগ্ন প্রবালের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের চারজন গবেষকের করা ওই গবেষণা বলছে, ২০১৬ সালে তা ৪১টিতে নেমে এসেছে।
দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অধিকতর নিচে নেমে গেছে। ছেড়া দ্বীপ ছাড়া অন্য এলাকায় জীবন্ত প্রবাল নেই বললেই চলে। সমুদ্র সৈকতে মানুষের অতিরিক্ত পদচারণার কারণে বিরল প্রজাতির কাছিমের বংশ বিস্তারও নেমে এসেছে শুণ্যের কোটায়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা দশ হাজারের মত। অস্থায়ী বাসিন্দা প্রায় দুই হাজার। বাড়ী– ঘর আছে প্রায় ১৫ শ। এরমধ্যে ১৫০টির মত গেষ্ট হাউজ, কটেজ, হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট।
১৯৯৯ সাল থেকে দ্বীপে পাকা দালান বাড়ী নির্মাণ নিষিদ্ধ। তারপরও সেখানে ২০টির মত পাকা দালান আছে যেগুলো মূলত: সাইক্লোন সেল্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি বিভিন্ন দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাসিন্দারা মনে করেন পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পর্যটকদের সচেতনতা না থাকায় দ্বীপের সৌন্দয ও প্রাণ বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে।
সেন্টমার্টিন্স ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ দাবি জানিয়েছেন ভ্রমণের উপর বিধি নিষেধ আরোপের আগে বাসিন্দাদের জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বীপের উত্তর–পশ্চিমাংশে ভাঙ্গনের প্রবণতা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার তা রোধ করতে না পারলে এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে।