২৪৭ বছর পর ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন
॥ ইফতেখারুল অনুপম ॥
টাঙ্গাইল: জেলার কালিহাতী উপজেলার কোকডহরা ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ (৫৫) লেখাপড়া জানেন না। নিজ জমির পর্চা তোলার জন্য ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) থেকে অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদনের ঠিক ১১ দিনের মাথায় তার বাড়ির ঠিকানায় ডাকযোগে পৌঁছে যায় জমির পর্চা।
দ্রুততম সময়ে সরকারি সেবা পেয়ে অভিভূত ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “নিজ গ্রামের ইউডিসি থেকে সরকার নির্ধারিত ফি মাত্র ১০০ টাকা জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। কোন ঝামেলা ছাড়াই ১১ দিনের মাথায় আমার জমির কাগজ আমার হাতে চলে এলো । তাও আসল র্পচা। এতো সহজে জমির পর্চা পাব তা কখনও ভাবি নাই।”
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির হোসেন (৪৮) পর্চার জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ১০০ টাকা জমা দিয়ে ইউডিসি থেকে অনলাইনে আবেদন করার ৮ দিনের মধ্যেই নিজের ঠিকানায় পর্চা পেয়েছেন। আমির হোসেন বলেন, “আগে পর্চা তুলতে এক মাসের বেশি সময় লাগত। টাকাও খরচ হতো বেশি। আর এখন কোথাও যাওয়া লাগে না। সাধারণ মানুষের জন্য কী যে সুবিধা হয়েছে, তা বলে বোঝানা যাবে না।”
টাঙ্গাঈল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন গড়ে ৮৫টির মতো আবেদন অনলাইনে জমা পড়ছে।
‘হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা’ কর্মসূচির মাধ্যমে ভূমিসেবায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন জমির মালিক ইউডিসি বা পৌরসভা ডিজিটাল সেন্টার (পিডিসি) থেকে অনলাইনে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে পর্চার জন্য আবেদন করতে পারেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে রেকর্ড রুম থেকে পর্চা প্রস্তুত করে ডাক বিভাগের গ্যারান্টেড এক্সপ্রেস পোস্টের (জিইপি) মাধ্যমে সরাসরি ব্যক্তির ঠিকানায় পর্চা সরবরাহ করা হয়। এতে জনগণের হয়রানি, সময় ও অর্থের অপচয় কমেছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় মিউটেশন বা নামজারি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। জমি ক্রয় বা অন্য কোন উপায়ে জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে হালনাগাদ রেকর্ড সংশোধন করতে হয়। পুরনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে জমি রেকর্ড করাকে নামজারি বলে। এই কাজটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সহজে করাই হচ্ছে ই-নামজারি বা ই-মিউটেশন।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সারাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ই-নামজারি সেবা চালু করা হয়। ই-নামজারি মানুষের হয়রানি অনেকটাই দূর করেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়, ভূমি সংস্কার বোর্ড এবং এটুআই যৌথভাবে মাঠ পর্যায়ে ই-নামজারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ই-নামজারি ্অ্যাপ্লিকেশনটি মূলত জমি সংক্রান্ত তথ্য সেবায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মের একটি অংশ। আগের নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ডরুম থেকে খতিয়ান বা পর্চা দেয়া হতো। খতিয়ানের কপি সংগ্রহের জন্য নানা জটিলতা, দীর্ঘসূত্রীতা, অপ্রত্যাশিত ব্যয় ও যাতায়াতের ভোগান্তি পোহাতে হতো। ই-নামজারি সেই সমস্যা দূর করেছে।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর “ডিজিটাল রেকর্ড রুম” উদ্বোধন করেন। সহজে ই-খতিয়ান প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে “হাতের মুঠোয় ভূমি সেবা” প্রতিপাদ্য নিয়ে এটুআই ও ভূমি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ডিজিটাল রেকর্ড রুম পরিচালনা করছে।
এ ব্যবস্থায় ঘরে বসেই অনলাইনে আবেদন ও অনলাইনে ফি দেয়ার পর নির্ধারিত সময় এবং নির্ধারিত স্থান থেকে খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে উপমহাদেশে কালেক্টরেট ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের প্রায় ২৪৭ বছর পর ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হলো।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শহীদ উল্লাহ তার জেলায় এ কর্মসূচিটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে টাঙ্গাইল জেলায় অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে শতভাগ ই-নামজারির কার্যক্রম শুরু হয় । বর্তমানে ই-নামজারির মাধ্যমে ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও উপজেলা ভূমি অফিসে হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে ভূমিসেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা মোটামুটি একই রকম ছিল। এখন ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের সুফল পেতে শুরু করেছে মানুষ। এর মাধ্যমে আবেদনকারীরা অনলাইনে তার আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন।
জানা যায়, ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি উন্নয়ন কর ও রাজস্ব আদায়, খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত, জলমহাল ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ এবং ভূমিসংশ্লি¬ষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এছাড়া মন্ত্রণালয় ভূমি আইন ও বিধি প্রণয়ন, ভূমিহীন ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ভূমি জোনিং কার্যক্রম, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ ও মেরামত, ভূমি রেকর্ড আধুনিকীকরণ, জনসাধারণকে স্বল্পতম সময়ে ভূমি সংক্রান্ত তথ্যাদিও সরবরাহ করে।
সরকারিভাবে জরিপ করা জমিজমার বিবরণ সংবলিত সরকারি দলিলকে বলে ‘খতিয়ান’। এই খতিয়ানে মৌজার দাগ অনুসারে ভূমির মালিকের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, মালিকানার বিবরণ, জমির বিবরণ, মৌজা নম্বর, সীমানা প্রভৃতির হিসাব থাকে। আর এই খতিয়ানের অনুলিপিকেই বলা হয় পর্চা। জমি কেনাবেচা, জমি রক্ষণাবেক্ষণ ও দখলে রাখার ক্ষেত্রে পর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্চায় কোনো সমস্যা থাকলে জমির মালিকানা ও জমি কেনাবেচার কাজে সমস্যা হয়।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলায় ১১৮টি ইউনিয়ন এবং ১১টি পৌরসভা । প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা কার্যালয় থেকে অনলাইনে পর্চার আবেদন করা যাচ্ছে।
গোপালপুর উপজেলার ধোপাকান্দি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম (৩২) বলেন, ডাকযোগে পর্চা পাঠানোয় সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে হাতে পৌঁছাতে ১৪/১৫ দিন লেগে যায়। দেরি হলে আবদেনকারীরা উদ্যোক্তাদের কাছে এসে জানতে চায়।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনি বলেন, টাঙ্গাইল জেলায় শতভাগ ই-নামজারি চালু রয়েছে। এর মাধ্যমে জেলা সদর, উপজেলা ও ইউনিয়নগুলোর ভূমি অফিসগুলোতে মানুষের ভোগান্তি কমেছে। বর্তমান সরকার আধুনিক, প্রযুক্তি নির্ভর ভূমি ব্যবস্থাপনা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্রামের সবার পক্ষে অনলাইনে নিজে আবেদন করা সম্ভব নয়। তাই এখন ইউডিসির মাধ্যমে আবেদন নেয়া হচ্ছে। তবে আবেদন প্রক্রিয়া সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। যাতে আবেদনকারীরা ঘরে বসেই পর্চার আবেদন করতে পারন সেজন্যও কাজ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর।-বাসস