ডক্টর দেবাশিস ঘোষ
(সিনিয়ার কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট)
অ্যাপোলো গ্লেনেগলস হসপিটাল, কলকাতা ।
হার্টের বয়স তো শরীরের সঙ্গে বাড়বেই। প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক সেই বার্ধক্য পুরোপুরি রোখা যাবে না কখনওই। শারীরবিজ্ঞানের নিয়ম মতে এ বার্ধক্য অনিবার্য। কিন্তু শরীরের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্টের গতি বাড়া ছাড়াও যদি আরও অন্যান্য কারণে হার্টের বয়স বাড়ার গতিটা বেড়ে যায়, তবে তা কখনওই কাম্য নয়। এখন প্রশ্ন হল, হার্টের বয়স বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে সমস্যা কী কী হতে পারে। হার্টের বয়স সময়ের চেয়ে আগে বেড়ে যাওয়া কি আটকানো যেতে পারে? যদি আটকানো না যায়, তার সমাধানই বা কী কী। বয়সের নিয়মে হার্ট বৃদ্ধ হলেই বা তার যত্ন কী ভাবে করবেন? এই সমস্ত বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনায় ডক্টর দেবাশিস ঘোষ।
দুর্বল পেশি, অস্থির ছন্দ
হার্টের প্রথম ও প্রধানতম একটি চূড়ান্ত সমস্যা হল, হার্ট ফেলিওর। এর মূল কারণ, হার্টের পেশি দুর্বল বা কমজোরি হয়ে যাওয়া। সাধারণত ৬৫ বছর বা তার ওপরের মানুষরা এই সমস্যায় পড়েন। বহুবিধ রোগের কারণে হার্টের পেশি দুর্বল হয়। এমনটা হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। ৬৫ বা তার বেশি বয়সের মানুষদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একটা প্রধান কারণই হল এই পেশির দুর্বলতাজনিত অসুস্থতা।
দ্বিতীয় বিষয়টা হল, হার্টের রিদম বা ছন্দে ব্যাঘাত ঘটা। হার্ট একটা নির্দিষ্ট ছন্দে চলে। তাতে সমস্যা হলে সেটাকে বলা হয় ‘এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন’। এই সমস্যাও মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তথা হার্টের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে।
রক্তকে পাম্প করাই হার্টের কাজ
হার্টের পেশির দুর্বলতার কারণ কয়েকটি নির্দিষ্ট রোগ। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল। স্মোকিং করাও এই দুর্বলতার একটা কারণ। এই দুর্বলতার আবার দুটি ধরন আছে। প্রথমটি হল, শরীরের আর পাঁচটা পেশির দুর্বলতা যেমন হয়, তেমনই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শক্তি কমে যাওয়া। একে বলে ‘কার্ডিও মায়োপ্যাথি।’ অন্যটি হল, হার্টের কোনও ব্লকেজের কারণে যদি রক্ত চলাচল কমে যায়, তাহলেও হার্টের মাসেল দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা হার্টের নিজস্ব সমস্যা নয়, রক্ত চলাচলের ব্যাঘাতের কারণে তৈরি হওয়া সমস্যা। একে বলে ‘করোনারি ডিজিজ’।
হার্টের পেশিগুলির মূলত দুটি কাজ আছে। প্রথমটি হল, হার্টকে পাম্প করে বা কনট্র্যাকশন করে অর্থাৎ সঙ্কোচন করে রক্তটা বার করা। আর অন্যটা হল, হার্টকে রিল্যাক্স করতে হবে। নইলে হার্টে রক্ত আসবে না। পাম্প করা এবং রিল্যাক্সেশন—এই দুইই হার্টের জরুরি কাজ। এখন বয়স বাড়লে যে কোনও অঙ্গেরই কার্যক্ষমতা কমবে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। হার্টের ক্ষেত্রেও তাই। হার্টের বয়স বাড়ায় প্রথম সমস্যাটা হয় রিল্যাক্সেশনের ক্ষেত্রে। একে বলে ডায়াস্টলিক ডিসফাংশন। এর ফলে হার্টে যতটা রক্ত আসার কথা, ততটা আসছে না। এ জন্য হার্ট ফেলিওর হতে পারে। এর পরে সমস্যা হয় কনট্র্যাকশনে, যাকে বলে সিস্টোলিক ডিসফাংশন। এই দুটো সমস্যাই বয়সজনিত।
নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই
এত অবধি যা ঘটছে, তা প্রকৃতি ও শারীরবিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই ঘটছে। এই বয়স হওয়া বা বয়সজনিত সমস্যাকে আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু হার্টের বার্ধক্যের গতি বাড়িয়ে দিতে পারে, অ অসুখ থাকলে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ। রক্তচাপ যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে হার্টের জন্য ঝুঁকির। এই নিয়ন্ত্রণ শুধু ওষুধ খেয়ে নয়, লাইফস্টাইল পরিবর্তন করেও করতে হবে। তার মধ্যে ওজন কমানো ও কাঁচা নুন না খাওয়া জরুরি। ১৪০/৮০—এই অঙ্কের ভিতরে রাখতে হবে রক্তচাপকে। এটা নিয়মিত মেনটেন করতে হবে। তা না হলে হার্টের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বয়স হওয়ার পদ্ধতি অনেক দ্রুত হয়ে যাবে।
উচ্চ রক্তচাপের মতোই হার্টের আরও এক শত্রু হল ডায়াবেটিস। আমি কখনওই বলব না, ডায়াবেটিস থাকা মানেই খুব বড় বিপদ হয়ে গেল। ডায়াবেটিসকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে আর পাঁচজন নন-ডায়াবেটিক মানুষের মতোই জীবন যাপন করা যায়। লাইফস্টাইল, ওষুধ, ইনসুলিন—এই সবই নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র। সেটা না করলে কিন্তু হার্টের বয়স দ্রুত বাড়বে। এক জন চল্লিশ বছরের মানুষের যদি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকে, তবে তাঁর হার্টের বায়োলজিক্যাল বয়স হতে পারে ৬৫!
এর পাশাপাশি আমি দুটো বিষয়ের দিকে নজর দিতে বলব, ওবেসিটি এবং স্মোকিং। এই দুটি বিষয়ও কিন্তু হার্টের বড় শত্রু। এই দুটিও লাইফস্টাইল দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ক্যানসারের তবু অ্যানসার আছে, হার্ট ফেলিওরের…
দুঃখের বিষয় হল, পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে কারও যদি একবার হার্ট ফেলিওর হয়ে যায়, তবে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই পরবর্তী ৫ বছরে রোগীর মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এটা খুবই চিন্তার বিষয় বলে আমি মনে করি। এখন ক্যানসারের মতো অসুখেরও এমন চিকিৎসা রয়েছে, যাতে রোগী ৫ বছরের বেশি বাঁচেন। কিন্তু হার্ট ফেলিওর হলে কিন্তু সেটা খুব মুশকিল। ফলে হার্ট ফেলিওর যাতে না হয়, মাসেল যাতে সময়ের আগেই দুর্বল না হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতেই হবে।
আমি বলব, এক্ষেত্রে প্রিভেনশনের কোনও বিকল্প নেই। তবু যদি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা দেখা যায়, তাহলে চিকিৎসা করান। এখন অনেক আধুনিক হয়েছে চিকিৎসা পদ্ধতি, ভাল ওষুধ বেরিয়েছে। ফলে নিয়মিত চিকিৎসায় থাকলে হার্টের সমস্যা আয়ত্বে রাখাও সম্ভব।
হার্টের সমস্যায় সেরিব্রাল স্ট্রোক
এবার বলি হার্টের ছন্দ বা রিদমে ব্যাঘাত ঘটার কথা। হার্ট একটা সুনির্দিষ্ট রিদমে চলে। এর ব্যাঘাত ঘটলে সেটা দ্রুত হতে পারে বা ধীর হতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত সমস্যা হল, অনিয়মিত ছন্দে দ্রুত হার্টবিট। বয়স যত বাড়ে, এই সমস্যা তত বাড়ে। ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সি মানুষদের ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সমস্যা। আবার ৮০ বয়সের বেশি মানুষদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।
এর দুটো সমস্যা। হার্ট খুব দ্রুতগতিতে পাম্প করলে, রক্তচলাচল ব্যাহত হবে, হার্ট ফেল করতে পারে। আর একটা সমস্যা হচ্ছে, এই অনিয়মিত ছন্দের কারণে হার্টে সূক্ষ্ম ক্লট জমতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সেই ক্লট ব্রেনে চলে যায়। এর ফলে সেরিব্রাল স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি হয়। অথচ এর উৎস কিন্তু হার্ট, তথা হার্টের অনিয়মিত ছন্দ, যার আসল কারণ হার্টের বার্ধক্য। একে বলে ‘কার্ডিওএম্বলিক স্ট্রোক’।
লাইফস্টাইলেই লুকিয়ে সুস্থতার চাবিকাঠি
এখন এই ‘এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন ’ কী ভাবে রোখা যেতে পারে? সমস্যা আলাদা হলেও এর সমাধান কিন্তু সেই একই রকম। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, ধূমপান—এই চারটি দিকে কড়া নজর দিতে হবে। তার পরেও যদি অসুখ এড়ানো না যায়, তাহলে চিকিৎসা প্রয়োজন। হার্টরেট কমানোর ওষুধ প্রয়োজন। পাশাপাশি ব্লাড-থিনার দিতে হয় রোগীকে, যাতে রক্ত সহজে জমাট না বাঁধে। হার্টের ছন্দে ব্যাঘাত ঘটলেও যাতে তার বিপদটা এড়ানো যায়।
দেখুন, আমি আবারও বলছি, হার্টের বয়স বাড়া আটকানো যাবে না। বয়স বাড়লে চোখে ছানি পড়ার মতো বা শ্রবণযন্ত্র দুর্বল হয়ে যাওয়ার মতোই হার্টের বয়স বাড়বেই। আমি বা আপনি কেউ ব্যতিক্রম নই। কিন্তু এই বয়স বাড়ার গতি যেন আমরা বাড়িয়ে না ফেলি সময়ের চাইতে। অন্য অসুখ শরীরে বাসা বাঁধলে এ ঝুঁকি বাড়ছে। ৬৫ বা ৭০ বছর বয়সে পৌঁছে হার্টের যে সমস্যা হবে, তা ৪০-৪৫ থেকে হওয়াটা কখনও কাম্য নয়। সুস্থ থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন। হার্ট ভাল থাকবে বহু দিন।
-দি ওয়াল