আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণে, জাম্বেজি ও লিম্পোপো নদীর মাঝখানে অবস্থিত অসামান্য সুন্দর দেশ জিম্বাবোয়ে। এলাকাটি ১৮৯০ সালে দখল করে নিয়েছিল ব্রিটিশ সাউথ আফ্রিকা কোম্পানি। তবে কোম্পানির শাসন শেষ হয়েছিল ১৯২৩ সালে। গঠিত হয়েছিল স্বশাসিত ব্রিটিশ কলোনি দক্ষিণ রোডেশিয়া। এর উত্তরে ছিল ব্রিটিশ কলোনি উত্তর রোডেশিয়া। যেটি বর্তমানে জাম্বিয়ার অংশ।
শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ রোডেশিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলেও, স্বীকৃতি দেয়নি ব্রিটেন। ফলে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল দেশটি। ১৫ বছর ধরে চলেছিল গৃহযুদ্ধ। শ্বেতাঙ্গ ও জাতীয়তাবাদী কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে। ইতিহাসে যার নাম ‘রোডেশিয়ান বুশ ওয়ার’। রোডেশিয়ার সেনাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলা। ১৯৮০ সালে হয়েছিল শান্তি চুক্তি। শ্বেতাঙ্গদের কবল মুক্ত হওয়ার পর দক্ষিণ রোডেশিয়ার নাম হয়েছিল ‘জিম্বাবোয়ে‘
মিশেক এনইয়ান্ডো
দক্ষিণ রোডেশিয়াতে যখন স্বাধীনতার লড়াই চলছিল, সেই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক মিশেক এনইয়ান্ডো। ১৯৭৭ সালে ২৭ বছরের যুবকটি যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ডাক এসেছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। ‘এমগাগাও’ এলাকার গোপন ক্যাম্পে হয়েছিল মিশেকের ট্রেনিং। এরপর তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ডান্ডে এলাকার ফ্রন্টলাইনে।
যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর প্রধান কাজ ছিল আহত গেরিলাদের চিকিৎসা করা এবং প্রয়োজনে রাইফেল চালানো। ফ্রন্টলাইনে গিয়ে মিশেক দেখেছিলেন শ্বেতাঙ্গ সেনাদের হাতে অকাতরে মারা যাচ্ছেন তাঁর সহযোদ্ধারা। তা দেখে মিশেক এক অদ্ভুত শপথ নিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যদি বেঁচে ফেরেন, তাহলে দেশকে কয়েকশো যোদ্ধার যোগান দেবেন।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন মিশেক। জিম্বাবুয়ে স্বাধীন হওয়ার পরে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৮৩ সালে এনইয়াঙ্গোবে সেনা ছাউনিতে থাকার সময় প্রথম বিয়েটা করেছিলেন। বিয়ের পর নিজে থেকেই শুরু করেছিলেন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রকল্প। কালের নিয়মে কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিতে হয়েছে, কিন্তু মিশেকের প্রকল্প থামেনি। একের পর এক বিয়ে করে গেছেন। এমনকি এক বছরে পাঁচটি বিয়েও করেছেন মিশেক।
বিয়ের ফসল হিসেবে এসেছে সন্তানের পর সন্তান
তবে নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দায় একটু থমকে গিয়েছিল মিশেকের বিয়ে ও সন্তান উৎপাদনের গতি। এখন আবার রকেটের গতিতে ছুটছে তাঁর প্রকল্প। এখনও পর্যন্ত মিশেক বিয়ে করেছেন ১৬টি। সন্তানের সংখ্যা ১৫১। এর মধ্যে প্রথম স্ত্রীর ১৩ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রীর ১২টি করে সন্তান। বর্তমানে তাঁর বেশ কয়েকজন স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।
মিশেকের স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়ের সংখ্যা ৫০, তারা আজ এম্বিরে, হারারে, মুটারে ও গুরুভের স্কুলে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের মধ্যে সেনাতে ৬ জন ও পুলিশে ২ জন কাজ করেন। অন্যান্য পেশায় আছেন আরও ১১ জন সন্তান। তাঁর ৩৬ জন ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মিশেকের এক ছেলে আবার বাবারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চারটি বিয়ে করেছেন এ পর্যন্ত।
‘দ্য হেরাল্ড’-এর সাংবাদিক গিয়েছিলেন মিশেকের খোঁজে
ঘটনাটি জনসমক্ষে আসার পর মিশেকের গ্রামে গিয়েছিলেন, জিম্বাবোয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ইসডোর গুভামোম্বে।সাংবাদিককে দেখে দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিলেন ৬৬ বছরের মিশেক। খান কুড়ি বাড়ি নিয়ে একটা গ্রাম। মিশেকের পরিবারের সদস্যদের নিয়েই গড়ে উঠেছে গ্রামটি। যদিও তাঁর বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানই শহরে বাস করেন। গ্রামে আছেন তাঁর ১৬ জন স্ত্রী ও বাকি সন্তানেরা। সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাড়ি তাহলে কুড়িটি কেন?” চোখ টিপে মিসেক বলেছিলেন, “হবু বউদের জন্য বানিয়ে রেখেছি।”
বাড়িগুলির মাঝখানে আছে মিশেকের বাড়ি। সেখানে তিনি একা বাস করেন। সেই ঘরে বসে সাংবাদিক মিশেককে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বর্তমানে আপনার পেশা কী?” অম্লান বদনে মিশেক বলেছিলেন, “পালা করে ১৬ জন স্ত্রীকে যৌনতৃপ্তি দেওয়া ও সন্তান উৎপাদন করা। এটাই আমার একমাত্র পেশা।” হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন সাংবাদিক। বলেছিলেন, “এটা কী করে পেশা হল!”
সাংবাদিকের পিঠ থাবড়ে মিশেক বলেছিলেন, তাঁর বড় হয়ে যাওয়া সন্তানেরা প্রত্যেক মাসে তাঁকে অনলাইনে টাকা পাঠায়। জামাইরাও টাকা পাঠায়। ওটাই মিশেকের বেতন। তা দিয়ে দিব্যি চলে যায় সংসার। এছাড়া কিছু জমিজমা আছে, সেখান থেকে ফসল আসে। সে সব মিশেক ভাগ করে দেন ১৬ জন বউকে। তবে যে জমি ছিল তাতে কুলোচ্ছিল না।
কিছুদিন আগে ভূমি সংস্কার করেছিল দেশের সরকার। এমভুরুউই পাহাড়ের উপত্যকায় থাকা মিশেককে দেওয়া হয়েছে ৯৬ হেক্টর জমি। মিশেক বলেছিলেন, “বুদ্ধিমান সরকার বুঝেছে, এত বড় পরিবারকে খাওয়াতে গেলে আমার আরও জমি দরকার। পুরো পরিবার নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি নতুন জমিতে চলে যাব। সেখানে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে।”
এক অদ্ভুত আইন আছে মিশেকের পরিবারে। প্রত্যেকদিন প্রত্যেক স্ত্রীকে মিশেকের জন্য রান্না করে নিয়ে আসতে হবে এবং ষোলটি মেনুই আলাদা হতে হবে। খাবার সুস্বাদু না হলে মুখেই তোলেন না মিশেক। সটান ছুঁড়ে ফেলে দেন। মিশেক বলেন, “প্রত্যেক স্ত্রীকে আমার এই আইন মানতেই হবে। আমি যখন তাদের আনা খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিই তারা বিরক্ত হয় না। এর থেকে তারা শিক্ষা নেয়। পরের বার ভালো রান্না করার দিকে মনোযোগী হয়।”
মিশেকের আজব রুটিন
অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ উশখুশ করতে করতে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলেন সাংবাদিক, “এই বয়সে রাতের পেশা আপনি সামলান কেমন করে ?” প্রশ্নটা শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মিশেক। সাংবাদিককে বলেছিলেন, “দেখুন, আমার শরীর আজও ১৮ বছরের ছেলেদের মত শক্তিশালী। প্রতি রাতে গড়ে চারজন করে স্ত্রীকে সঙ্গ দিই।” চোখ কপালে তুলে সাংবাদিক বলেছিলেন, “চারজন!” রোস্ট করা মুরগিতে কামড় দিয়ে মিশেক বলেছিলেন, “অবশ্য এরজন্য আমাকে রোজ সকালে উঠে রুটিন তৈরি করতে হয়।”
‘রুটিন!’, আকাশ থেকে পড়েছিলেন সাংবাদিক। মিশেক চোখ কুঁচকে বলেছিলেন, “রাতে আমি কোন কোন স্ত্রীর ঘরে ডিউটিতে যাব তার রুটিন। আমার কাজই হল স্ত্রীদের যৌনসুখ দেওয়া। প্রত্যেককে তাদের চাহিদা মত যৌন সুখ দিই। তাই সকালে উঠেই নাইট ডিউটির প্ল্যান করে নিই। অবশ্য আগে থেকে কোনও স্ত্রী জানতে পারে না, সেই রাতে কার ঘরে যাব।”
যখন মিশেকের পাঁচজন স্ত্রী ছিল, তখন তিনি প্রত্যেক স্ত্রীকে পর পর দু’রাত সঙ্গ দিতেন। কিন্তু স্ত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর, রুটিন করতে বাধ্য হয়েছিলেন মিশেক। তবে রুটিনের বাইরেও মাঝে মধ্যে বিকেলের দিকে ডিউটি করেন। তবে সে ডিউটি নিয়মিত না। ঘটনাচক্রে ঘটে যায়। মিশেক সাংবাদিককে বলেছিলেন, তাঁকে নিয়ে তাঁর স্ত্রীরা খুব খুশি। বিশ্বাস না হলে, প্রত্যেক স্ত্রীকে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করতে পারেন সাংবাদিক।
এক রাতে চার স্ত্রীকে সামলানোর রহস্যটা কী!
সাংবাদিক অস্ফুটে বলেছিলেন “তাই বলে রোজ রাতে চারজন মহিলাকে সামলানো!” সশব্দে হেসে উঠেছিলেন মিশেক। তারপর বলেছিলেন, “দেখুন এর মধ্যে কোনও ম্যাজিক নেই। আসলে আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করি। তাই প্রত্যেক স্ত্রীকে প্রতিবার আমার নতুন বলে মনে হয়। নতুন উত্তেজনা ও শক্তি অনুভব করি। আমি যখন তাদের সঙ্গে মিলিত হই, তাদের বয়স ও চাহিদার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিই। যাতে তারা পূর্ণ তৃপ্তি পেতে পারে।”
তবে মিশেক এই বছরেই আরও দু’তিনটি বিয়ে করতে চলেছেন। কারণ তাঁর বয়স্ক স্ত্রীরা আর মিলনে আগ্রহী নন। তাঁরা মিশেককে কম বয়সের স্ত্রীদের কাছে যেতে বলেন। এই জন্যে ইদানীং মাঝরাতে মিশেককে রুটিন বদলাতে হচ্ছে। বিরক্ত মিশেক তাই জুলাই মাসেই বছরের প্রথম বিয়েটি করতে চলেছেন। তিনি সাংবাদিককে জানিয়েছেন, আজ পর্যন্ত তাঁকে কেউ স্ত্রী জোগাড় করে দেয়নি। তিনি প্রত্যেক স্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রত্যেক স্ত্রীকে লোবোলা (কন্যাপণ) দিয়ে চার্চে বিয়ে করেছেন। তবে কখনও কোনও নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে করেননি মিশেক।
সাংবাদিক কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। নিজের ঢাক নিজেই পিটিয়ে মিশেক বলেছিলেন,“ আমার প্রত্যেক স্ত্রী ও সন্তান জানে, একমাত্র আমার যদি মৃত্যু হয় তবেই আমার বিয়ে করা ও বাবা হওয়ার প্রকল্পটি বন্ধ হবে। তাই আজও চলছে আমার সাধের প্রকল্প। দেশের অর্থনীতি ধসে যাওয়ায় সামান্য মুস্কিলে পড়েছিলাম। না হলে এতদিনে আমার ৩০ জন স্ত্রী ও ২০০টি সন্তান হয়ে যেত। আপনি যদি পরের বছর আসেন, দু’তিনজন নতুন বউ ও আরও কিছু ছেলেপুলে দেখতে পাবেন।” অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন মিশেক।
সাংবাদিকের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিল। উঠে পড়েছিলেন চেয়ার থেকে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিশেক বলেছিলেন, “শেষ ছ’বছরে আমি ২২ জন সন্তানের বাবা হয়েছি। তাই খেলা এখনও শেষ হয়নি বন্ধু। বলতে পারো সবে শুরু। ঈশ্বর অনুমতি দিলে আমি ১০০ জন স্ত্রী ও ১০০০ জন সন্তানের লক্ষ্যে পৌঁছব। আফ্রিকার জনসংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা করেছে ইউরোপ আমেরিকা। এর বিরুদ্ধে আমার রাতের লড়াই চলছে।” বলেই গ্রাম কাঁপিয়ে হেসে ফেলেছিলেন মিশেক। কথা হারিয়ে ফেলা সাংবাদিক ঝনঝন করতে থাকা মাথা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়েছিলেন গাড়ির দিকে।