Home ব্যাংক-বিমা ‍বিদায়ী বছরে ফিরে দেখা ব্যাংকিং খাত

‍বিদায়ী বছরে ফিরে দেখা ব্যাংকিং খাত

সংকটময় একটি বছর পার করেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। নানামুখী উদ্যোগ সত্তে¡ও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি। উল্টো ব্যাংকগুলোর ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়েছে। বছরজুড়ে ঋণের সুদের হার নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা গেছে। কোনো নিয়মের মধ্যেই ছিল না ঋণ ও আমানতের সুদহার। বছরের একেবারে শেষভাগে এসে ঋণ আমানতের সুদের হার নিয়ে ‘নয়ছয়’ ফর্মুলা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন পদ্ধতিতে শুধু শিল্পঋণের সুদ ৯ শতাংশের মধ্যে থাকছে। আগামী জানুয়ারি থেকে শিল্প খাতে এই সুদের হার কার্যকর করা হবে। পাশাপাশি ইচ্ছামতো আমানতের সুদহার নির্ধারণের সুযোগ পাবে ব্যাংকগুলো! এদিকে চলতি বছরের শুরুতে আরও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিলেও দীর্ঘ ১০ মাসেও তা চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতের এমন সংকটের মাঝেও বছরজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ‘মহাসংকটে’। এক পিপলস লিজিং ভুগিয়েছে গোটা আর্থিক খাতকে।

এ বছরের শুরু থেকেই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল ঋণ আমানতের ‘নয়ছয়’ ফর্মুলা। ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে বা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বেশ কয়েকবার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ৯ বার নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যানদের ডেকে এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। সুদের হার কমানোর শর্তে ব্যাংকগুলোকে ৫ ধরনের বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এসব সুবিধা নিয়েও তারা সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামাননি। এই অবস্থায় গত মাসে ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। ওই বৈঠকে ‘নয়ছয়’ সুদহারের যে ফর্মুলা আছে সেটি বাতিলের কথা বলা হয়। আরো বলা

হয়, নির্দিষ্ট খাতের ঋণে সর্বোচ্চ (সীমা) ৯ শতাংশ সুদহার বেঁধে দেয়া হবে। কীভাবে কার্যকর হবে তা নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটি ইতোমধ্যে চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। সেই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে জানুয়ারি থেকে উৎপাদন খাতের ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ-আমানতের সুদহারের পাশাপাশি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিদের বৈঠক আলোচনায় আসে খেলাপি ঋণের বিষয়টিও। ঋণের সুদহার বেশি থাকায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে- বৈঠকে এমন যুক্তি তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর মতে, জানুয়ারি থেকে শিল্প ঋণে সুদহার কমলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে। বাস্তবিক চিত্রে খেলাপি ঋণ আদৌ কমবে কিনা এখন সেটাই দেখার বিষয়।

পরিসংখ্যান বলছে, নানামুখী উদ্যোগ সত্তে¡ও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি। উল্টো এ সময়ে ব্যাংকগুলোর ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৭৩ কোটি টাকাই মন্দ মানের খেলাপি। অথচ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে ঋণ শ্রেণিকরণের সময় বাড়ানো হয়েছে। জারি করা হয়েছে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই (জানুয়ারি-জুন) পুনঃতফসিল করা হয়েছে ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। পরবর্তী সময় তিন মাসেও রেকর্ড সংখ্যক ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। তারপরও কমেনি খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণ।

দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো অর্থহীন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাতে সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। অন্যরাও এতে উৎসাহ পাচ্ছে। খেলাপিদের যদি ভালো গ্রাহকদের তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি খারাপই হবে।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকে হতাশাজনক বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, খেলাপি ঋণ হলো ক্যান্সারের মতো। একটি অঙ্গ সংক্রমিত হলে তা অন্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় গণহারে খেলাপির সংস্কৃতি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়। এখন এটি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ আমরা একই পরিবেশ ও সংস্কৃতিতেই ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছি।
এদিকে চলতি বছরের শুরুতে আরও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক। কিন্তু প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে না পারায় বারবার হোঁচট খাচ্ছে নতুন ব্যাংকের চ‚ড়ান্ত অনুমোদন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌন সম্মতি পাওয়ার পর ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে ১০ মাস। এত দিনেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকিং খাতের এসব সংকটের মাঝে বছরজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিলো ‘মহাসংকটে’। একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা। জমাকৃত ৭০০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ছুটছেন সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রায় সব মহলেই টাকার জন্য ধর্ণা দিয়েছেন তারা। পেয়েছেন শুধুই সান্ত¡না। কিন্তু কোনো কিছুতেই আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না আমানতকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পিপলসের আমানতের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকাই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। এর পাশাপাশি প্রায় ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বিভিন্ন অনিয়ম বের হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি থেকে পরিচালক সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন ও খবির উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। আর চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন স্বেচ্ছায় পদ ছাড়েন। এরপরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত জুলাই মাসে পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একটি অডিট প্রতিষ্ঠানকে পিপলস লিজিংয়ের খুঁটিনাটি দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে অর্থ লুণ্ঠনের অভিযোগে ৯ পরিচালকের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও শেয়ার জব্দ করা হয়।

পিপলস লিজিংয়ের মতো অবসায়ন প্রক্রিয়ায় না থাকলেও, স্বস্তিতে নেই দেশের নন-ব্যাংকিং বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই আমানতের পরিমাণ কমে গেছে, সামান্য বেড়েছে ঋণ বিতরণ। একই সঙ্গে ঋণ আদায়ের পরিমাণ কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের দুর্দশা দেখে অনেকেই আর নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। ফলে পুরো খাতই মহাসংকটে পড়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, দেশে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৬টি। সারাদেশে এগুলোর ৭৫৫টি শাখা রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে লাল তালিকায় বা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮টিকে ফেলেছে হলুদ তালিকায়। সবুজ বা ভালো তালিকায় পড়েছে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান।

মরিয়ম সেঁজুতি