২০০ বছর পরে এই গ্রহাণুই আছড়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে অ্যাস্টেরয়েড-বেল্টে থাকা রহস্যময় গ্রহাণু বেন্নুতেই একসময় জলের খোঁজ পেয়েছিল নাসা। তার বুকে নেমে অস্থি-মজ্জার খোঁজ করার মিশন তৈরি হয়েছিল সে দিনই। প্রথমবার কোনও গ্রহাণুর পিঠে নেমে তার থেকে নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে আনার এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা ছিল নাসারই। সেই অভিযানই সফল হল। বেন্নুতে অবতরণ করে নমুনা সংগ্রহ করে ফেরার মুখে নাসার মহাকাশযান।
‘ওসিরিক্স রেক্স’—নাসার এই মহাকাশযানকে বেন্নুর পাড়ায় পাঠানো হয়েছিল ২০১৬ সালেই। এতদিন গ্রহাণু চারদিকে চক্কর দিয়ে তার হাল হকিকত বুঝেছে এই মহাকাশযান। দফায় দফায় ছবি পাঠিয়েছে পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনে। রুক্ষ, বন্ধুর, এবড়ো খেবড়ো বেন্নুর পিঠে গতিবেগ সামলে অবতরণ করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যপার। অজানা গ্রহাণুর বুকে বিপদের সম্ভাবনাও আছে। মহাজাগতিক রশ্মি, ধবমকেতু, উল্কা প্রায়ই আছড়ে পড়ে বেন্নুতে। তার আকারও যে খুব বড় এমনটা নয়। তাই সবমিলিয়ে চিন্তা একটা ছিলই।
নাসার প্রধান জিম ব্রিডেনস্টাইন আজ টুইট করে জানিয়েছেন, সব চিন্তাভাবনার অবসান হয়েছে। নাসার ঐতিহাসিক মিশন সফল। বেন্নু গ্রহাণুর পিঠে নেমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মাটি-নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে ফিরে আসছে ওসিরিক্স রেক্স। পাথুরে মাটিতে অবতরণের সময় তার গতিবেগ টলেনি, মাটি খামচে নিতেও সমস্যা হয়নি। চাঁদের পিছে অ্যাপোলো মিশনের পরে প্রথমবার এক দুঃসাহসিক অভিযানে সাফল্য পেল নাসা।
অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে মহাজাগতিক মেঘে ঢাকা বেন্নু, রুক্ষ-পাথুরে পিঠে ছড়িয়ে খনিজ
পৃথিবীর কাছেপিঠে যত গ্রহাণু রয়েছে তার মধ্যে বেন্নুর আকারই কিছুটা বড়। তাই মহাকাশযান নামানোয় কোনও সমস্যা নেই। পৃথিবী থেকে বেন্নুর দূরত্ব ২০ কোটি ৭০ লক্ষ মাইল (৩৩ কোটি ৪০ লক্ষ কিলোমিটার)। এই গ্রহাণুর ঠিকানা মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে। এই ব্রহ্মাণ্ডে যত গ্রহাণু আছে তাদের ঠিকানাই হল এই অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট। বেন্নু আবার স্বভাবে লাজুক। নাসার মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেছেন, ঘন মেঘে মুখ লুকিয়ে রেখেছে বেন্নু। এই মেঘ তৈরি হয়েছে মহাজাগতিক কণা দিয়ে।
মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিভিন্ন গ্রহাণু থেকে ছিটকে যাওয়া অংশ, ধূমকেতুর বিচ্ছিন্ন অংশ, ছোট ছোট মহাজাগতিক কণা মিলে ঘন মেঘ তৈরি করেছে বেন্নুর আকাশে। অতীতে বিশাল উল্কাপাতের চিহ্ন রয়েছে বেন্নুর বুকে। আছড়ে পড়েছে ধূমকেতু, মহাজাগতিক রশ্মি। সেই ছাপ আজও বয়ে চলেছে এই গ্রহাণু। তাই তার মাটি রুক্ষ, বন্ধুর। এবড়ো খেবড়ো পিঠ। এতই রুক্ষ পরিবেশ যে মহাকাশযানের অবতরণ সঠিকভাবে না হলেই মুশকিল। তার উপর মাটিতে ছড়িয়ে নানারকম খনিজ। এই খনিজ উপাদানগুলি তুলে আনাই লক্ষ্য ছিল ওসিরিক্স-রেক্সের।
নাইটিঙ্গেল গর্তে নেমেছিল ওসিরিক্স-রেক্স
বেন্নু গ্রহাণু মাটি এতটাই বন্ধুর যে ঠিক কোন জায়গায় মহাকাশযান নামাতে হবে তার জন্য বিস্তর হিসেব নিকেশ করতে হয়েছে নাসাকে। অবশেষে গ্রহাণুর উত্তর মেরুতে মিলেছে সেই কাঙ্খিত জায়গার হদিশ। নাইটিঙ্গেল গহ্বর। পরিধি ৪৯০ মিটারের (১৬০০ ফুট) কাছাকাছি। এই গহ্বরকে ঘিরে রয়েছে খাড়ই পাহাড়। এখানকার মাটিও খুব এবড়ো খেবড়ো। তবে নাইটিঙ্গেল ক্রেটারে ছড়িয়ে রয়েছে নানারকম খনিজ উপাদান। মাটির ধূলিকণায় মিশে আছে সে সব খনিজ। এই গহ্বর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে নাসার ওসিরিক্স-রেক্স।
‘টাচ অ্যান্ড গো’ মিশন, ১৬ সেকেন্ডে মাটি খামচে এনেছে নাসার যান
সময় খুব কম। তার মধ্যেই মাটি খামচে আনতে হয়েছে নাসার ওসিরিক্স-রেক্সকে। এই কাজ খুব সহজ নয়। ওসিরিক্সের আকার ছোটখাটো একটা ভ্যানের মতো। মাটি-নুড়ি কুড়নোর জন্য এই মহাকাশযানে রয়েছে ২৬ ফুটের বিশাল যান্ত্রিক হাত যাকে বলা হচ্ছে ‘রোবোটিক আর্ম।’ বিশাল হাতে মাটি, ধূলিকণা তুলে ফটাফট মহাকাশযানের পেটে পুরে দেওয়ারই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সময় ছিল মাত্র ১৬ সেকেন্ড। তার মধ্যেই ৬০ গ্রাম মাটি তুলে নিয়েছে রোবোটিক আর্ম। এই মাটিতে মিশে খনিজ। মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই খনিজ উপাদান বিশ্লেষণ করেই সৌরমণ্ডলের অনেক অজানা রহস্যের খোঁজ মিলবে।
বেন্নু-অভিযান কেন ঐতিহাসিক
মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলছেন, পাথুরে গ্রহাণুগুলি থাকে মূলত মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝখানে। তাই মনে করা হয় এই গ্রহাণুগুলো সৌরমণ্ডল তৈরির সময় থেকেই রয়েছে। তাই এরা কী পদার্থ দিয়ে তৈরি সেটা জানা গেলেই সৌরজগতের অনেক রহস্যের খোঁজ মিলবে। গ্রহাণু থেকে যে সব ছোট ছোট কণা প্রতিনিয়ত ছিটকে বেরোয় তাদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য খতিয়ে দেখাও জরুরি। তাহলেই সৌরজগত আর গ্রহাণুদের মধ্যেকার সম্পর্কটা আরও খোলসা হবে মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে।
তাছাড়া নিয়ার আর্থ আবজেক্ট যত আছে তার মধ্যে বেন্নুতেই প্রথম জলের খোঁজ মিলেছে। গবেষকরা বলছেন, গ্রহাণুতে যে পরিমাণে খনিজ পদার্থ রয়েছে তা থেকে প্রচুর পরিমাণে জল বের করে আনাও সম্ভব। আর বেন্নুতে রয়েছে লোহা-সহ প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ। আর সেগুলি রয়েছে লোহা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের অক্সাইড যৌগ হিসেবে। তাই প্রাণের স্পন্দন রয়েছে কিনা সেটাও জানা যাবে এই মিশনের পরেই।
-দি ওয়াল