Home স্বাস্থ্য খাদ্য ও হৃদরোগ : খাবারের জুজু ফ্যাট

খাদ্য ও হৃদরোগ : খাবারের জুজু ফ্যাট

খাবারের পাতে ফ্যাট একটা ত্যাজ্যপুত্রের মত ব্যাপার,আপনি যদি রোগবিলাসী হন তাহলে তো কোনো কথাই নেই আর ভোজনবিলাসী হলে যে যাই বলুক খাবার আপনাকে ডাকবে এবং আপনি তার মায়াবী  হাতছানি এড়াতে পারবেন না l

খাবারের পাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ফ্যাট নিয়েই, কিন্তু ফ্যাট আমাদের নিয়মিত সুস্থ ডায়েটের একটা আবশ্যক উপাদান হওয়া উচিত l আমাদের বোঝার ভুলে আমরা ফ্যাট বর্জন করছি l ফ্যাট জাতীয় খাবার খেলেই মোটা হয়ে যাবেন সেটা কিন্তু ঠিক নয় l আবার প্রচুর ফ্যাট জাতীয় খাবার খেলেই বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের মতো বাইসেপ্সের অধিকারি আপনি হবেন সেই গুড়েও বালি l

Saturatedfats2.jpg

খাবারের শ্রেণিবিভাগ করলে তিনটি ভাগ পাওয়া যায় l যেমন : প্রোটিন,কার্বোহাইড্রেট ও লিপিড, এই লিপিডেরই একটি প্রকার হল ফ্যাট যা সাধারণ উষ্ণতায় কঠিন l ফ্যাট থেকে আমার ফ্যাটি অ্যাসিড পাই, যা বিপাকীয় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে l ভিটামিন এ, ডি এবং ই ফ্যাট দ্রবণীয়, তাই ফ্যাট ভিটামিনের কাজেও সহায়তা করে l এই ফ্যাট থেকে যকৃৎ-এ কোলেস্টেরল উৎপন্ন হয় l

Everything-You-Know-About-Cholesterol-Is-Wrong_header.jpg

কোলেস্টেরল নামটা শুনলেই অনেকে আঁতকে ওঠেন, কিন্তু তার মধ্যে ভালো এবং খারাপ দুইই আছে l ফ্যাট-মূলত চার প্রকার তাতে উপস্থিত ফ্যাটি অ্যাসিড-এর ভিত্তিতে, যথা স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড(PUFA)  মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (MUFA), ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড  l
এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি থেকে 4 প্রকার লাইপোপ্রোটিন উৎপন্ন হয়, যাদের আমরা চলতি কথায় কোলেস্টেরল বলে থাকি l লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL), ভেরি লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (VLDL), খুবই অল্প পরিমাণে  ইন্টারমিডিয়েট ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (IDL) এবং হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (HDL) l
LDL ক্ষতিকর যা,স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে উৎপন্ন হয় এবং এটি ‘ব্যাড কোলেস্টেরল’ নামে পরিচিত l HDL আমাদের শরীরের পক্ষে উপকারী,এটি সংশ্লেষিত হয় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে যা ‘গুড কোলেস্টেরল’, নামে পরিচিত l

good_vs_bad_cholesterol.PNG

তাই এমন খাবার আমাদের রসনা তালিকায় রাখতে হবে, যা HDL বা অসম্পৃকৃক্ত ফ্যাট-এ সমৃদ্ধ, যেমন সালমন মাছ, ইলিশ যাতে প্রচুর পরিমানে ওমেগা-3 এবং ওমেগা-6 ফ্যাটি রয়েছে, কর্ড লিভার অয়েল, সয়াবিন অয়েল ও সানফ্লাওয়ার অয়েল (PUFA ও MUFA সমৃদ্ধ ), মার্জারিন, মাঠা তোলা দুধ ইত্যাদি l
অন্য দিকে আমাদের এড়াতে হবে সম্পৃক্ত ফ্যাট যা ব্যাড কোলেস্টেরল-এর মাত্রা বাড়ায়, খাবারের পাতে ঘি, মাখন,বড়ো মাছ, রেড মিট, ডিমের কুসুমকে নো এন্ট্রি, তাই ডায়েট হতে হবে লো ফ্যাট যুক্ত, কিন্তু নো ফ্যাট কখনওই নয় l
ফ্যাট ফুল ডায়েট মানেই আপনি স্থূল হবেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত l স্থূলত্ব অর্থাৎ ওবিসিটি নির্ধারণ করা হয় বি. এম.আই দ্বারা যদিও বি.এম.আই সব দেশে সমান নয়, এক এক দেশে এক এক রকম মানকে পরম মান,হিসেবে ধরা হয় l

36232379.jpg

খাবারের সঙ্গে হৃদরোগ ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত, স্বাস্থ্যসম্মত আহার যেমন হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে ঠিক তেমনি অত্যধিক ফ্যাট যুক্ত খাবার হৃদরোগের অন্যতম কারণ l এই পৃথিবীতে প্রতি বছর বহু মানুষ  হৃদ রোগে আক্রান্ত হন এবং মারা যান, আমাদের ভারতের ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা নেহাত কম না l পশ্চিমি দেশগুলির থেকে বরং বেশি l গত শতকে যেখানে হৃদরোগের হার ছিল পনেরো শতাংশ, এখন তা 28 শতাংশে এসে ঠেকছে অর্থাৎ প্রতি 100 জনে 28 জন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান l 2018-19  সালে ভারতে প্রায় 30 লক্ষের মতো মানুষ  হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন, আমাদের দেশে মৃত্যুহারের কারণ হিসেবে যে রোগ গুলির নাম উঠে আসে সেই তালিকায় প্রথম দিকে থাকে হৃদরোগ  l ভারতে 70 বছরের নিচে বৃদ্ধদের এবং 30 বা তার কিছু কম থেকে 40-45 বছর বয়সিদের মধ্যে হৃদরোগ বেশি হবার প্রবণতা পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি গ্লোবাল মেডিক্যাল জার্নালের অনুসন্ধানে l যদিও সব বয়সি মানুষদেরই এর প্রবণতা থাকে l

cholesterol_plaque_artery_800_480_85_s_c1.jpg
হৃদরোগের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত স্নেহপদার্থ অর্থাৎ ফ্যাটযুক্ত খাবারই দায়ী, ইসকেমিক হার্ট ডিজিস, মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন, করোনারি  হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক, হার্টঅ্যাট্যাক ইত্যাদির জন্য  খাদ্যাভাস অনেকটাই দায়ি l

হৃদপিন্ড দেহের রক্তসংবহনতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, অসংখ্য রক্তবাহক ও রক্তজালক সংবাহনে সাহায্য করে l ধমনি বিশুদ্ধ রক্ত পরিবহন করে এবং শিরা দূষিত রক্ত পরিবহন করে l এই ধমনি ও শিরার অন্তর্গাত্রে খাদ্যের অতিরিক্ত ফ্যাট ক্রমাগত জমা হতে থাকে l রক্তবাহের অভ্যন্তরীণ ব্যাস কমে যায় ফলে রক্ত প্রবাহিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, রক্তচাপ বেড়ে যায় l যা স্ট্রোকের অন্যতম কারণ l

Carotid_hdl_87521258_M.jpg

রক্তবাহের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় ফলে আর প্রসারিত হতে পারে না যা “আর্থেরোস্ক্লেরোসিস” নামে পরিচিত l ওই জমা ফ্যাটকে “আর্থেরোস্ক্লেরোসিস প্ল্যাক” বলে l অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাট বেশি পরিমাণে জমা হলে রক্ত চলাচল প্রায় সম্পূর্ণ রূপেই বন্ধ হয়ে যায় যাকে চলতি কথায় হার্ট ব্লকেজ বলা হয়ে থাকে l এই ব্লকেজ বেশি সংখ্যায় হলে রক্ত সংবহন ব্যাহত হয় l

wbz-what-is-atherosclerosis.jpg

তখনই হার্ট অ্যাট্যাক হয়, অনেক সময় আগে থেকে কোনো লক্ষনই প্রকাশ পায় না l রক্ত সংবহন পুরোপুরি ব্যর্থ হলেই হয় হার্ট ফেল l ব্লকেজের ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাফি করা হয়, ব্লকেজ কোথায় আছে তা নির্ধারণ করবার জন্য এবং তারপর এনজিওপ্লাস্টি করে বা স্টেন্ট বসিয়ে সংবহন সচল করা হয় l একাধিক ব্লকেজ এর ক্ষেত্রে বাইপাস করা হয় অর্থাৎ শরীরের অন্য কোনো স্থানের ধমনি বা শিরা নিয়ে হৃদযন্ত্রে অন্য একটি রক্ত সংবহন পথ তৈরি করে দেওয়া হয় l

meditations-for-a-kind-heart-kmc-liverpool.jpg

কথায় বলে, prevention is better than cure, তাই অনেকটা যখন আমাদের হাতেই আছে l আমাদের সুস্থ জীবন যাপন আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে l খাবার আমাদের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু হতে পারে আবার সবচেয়ে , আমরা খাবারকে বন্ধু বানাবো না শত্রু বানাবো সেটা সম্পূর্ণ আমাদের নিজেদের বিচার্য, জিভ সংবরণ করলে যদি আয়ু বাড়ে, তাহলে আর ক্ষতি কি!!!!

লেখকঃ সৌভিক রায়