পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা ছিল অর্থায়ন সমস্যা। স্বল্পসুদে দীর্ঘসময়ে পরিশোধযোগ্য সহজ ঋণ ব্যবহারের শর্তসমূহ কঠিন হয়ে থাকে। শর্তসমূহ মোকাবিলাতে যে সময় পার হয় তাতে আবার নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রধান দশটি সেতু যথা যমুনা (বঙ্গবন্ধু), পদ্মা (লালন শাহ), ধলেশ্বরী (মোক্তারপুর), মেঘনা, গোমতী, কীর্তনখোলা (দপদপিয়া), রূপসা (খান জাহান আলী), ভৈরব (সৈয়দ নজরুল ইসলাম), তৃতীয় কর্ণফুলী, দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা নির্মাণের অভিজ্ঞতায় পাঁজিপুঁথি ঘেঁটে দেখা গেছে প্রতিটি সেতু নির্মাণের প্রকৃত ব্যয় মূল প্রাক্কলন থেকে কমবেশি প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধলেশ্বরী, মেঘনা, গোমতী ও দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু নির্মিত হয় অনুদানে, বাকি সব কটি সেতু বিদেশি ঋণ এবং ঋণ অনুদান মিশেলে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় (বিশেষ করে যমুনা, রূপসা ও দপদপিয়া সেতুর ক্ষেত্রে)। অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক কঠিন শর্ত ও তিক্ত অভিজ্ঞতা (যেমন তৃতীয় কর্ণফুলী, লালন শাহ ও ভৈরব সেতুর ক্ষেত্রে)। পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন সমস্যাটিই প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা এবং তা কাটাতে বড় সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে দাতা সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন নির্দিষ্ট ছিল এবং চুক্তিও হয়েছিল। দাতা সংস্থার কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে অতি সহজ শর্তে (সুদের হার .৭৫-১.০০%, আট/দশ বছর গ্রেস পিরিয়ড, পরিশোধকাল ত্রিশ বছর ৬০ কিস্তিতে) পাওয়া ঋণের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন (যা যমুনা সেতুতে ছিল ৩৭%, পদ্মা সেতুতে ২০১১ সালে প্রথম সংশোধনের সময় ৩২% থেকে ২১% এ নেমে আসে এবং বিশ্বব্যাংককে ড্রাইভিং সিট দেওয়া সাব্যস্ত হওয়ায় দাতা সংস্থার হিস্যা পূর্বের ৬৮% থেকে ৭৯%-এ উন্নীত হয়। ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিজস্ব অর্থায়নের সংস্থান নিজের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় যেখানে সেই শুরু থেকেই, তাই এডিপির অব্যয়িত টাকা বাঁচিয়ে, লেভি/ সারচার্জ আরোপ করে, যমুনা সেতুকে সিকিউরিটাইজেশনের মাধ্যমে সিকিউরিটি মার্কেট থেকে পুঁজি আহরণ করে, এমনকি প্রবাসীদের ইক্যুইটি দিয়ে এবং ইতিমধ্যে যমুনা সেতুতে অর্জিত উদ্ধৃত অর্থ ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে পথে না গিয়ে বিশ্বব্যাংক গংদের ওপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় ২০১১ সালেই প্রধান দুই দাতা সংস্থার অর্থায়ন (১২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা) অনিশ্চিত হওয়ার প্রেক্ষাপট পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছিল বাংলাদেশকে। এমনকি এক পর্যায়ে বিকল্প ব্যবস্থাপনা হিসেবে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রস্তাবও এসেছিল। এটি গ্রহণের ব্যাপারে প্রধানতম যে বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হয়েছিল তা ছিল বিওওটি (ইঁরষঃ ঙহি ঙঢ়বৎধঃব ধহফ ঞৎধহংভবৎ) পদ্ধতিতে লগ্নিকৃত টাকা ওঠানোর জন্য পদ্মা সেতুর মালিকানা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বছর (জানা মতে ৩৬ বছর) বিনিয়োগকারীর হাতে থাকবে। মালিকানার সময়সীমা আরও প্রলম্বিত হতে পারে যদি সেতুটির পর্যাপ্ত ব্যবহার ও মাশুল/টোলের হারে তারতম্য ঘটে। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি টাকা ওঠাতে গেলে টোল বাড়াতে হবে, টোল অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ালে সেতু ব্যবহার কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। টোলের পরিমাণ ভেদে সেতুর ব্যবহারে গণ-উপযোগিতায় রকমফের সৃষ্টি হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ পাঁচটি বড় ভাগে (প্যাকেজে) ভাগ করা হয়েছিল। এগুলো হলো মূল সেতু, নদীশাসন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজাসহ সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস-২ এলাকা (অফিস, ৩০টি ডুপ্লেক্স বাড়ি, ল্যাবরেটরি, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ অন্যান্য স্থাপনা) নির্মাণ। ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায় মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক এবং সার্ভিস-২ এলাকা নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগ পায় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। তারা সহযোগী হিসেবে নেয় মালয়েশিয়ার এইচসিএম নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। আবদুল মোনেম কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের অক্টোবরে। শেষ করে ২০১৬ সালে। বিভিন্ন কাজের তদারকে চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও তিনটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে পরামর্শকের দায়িত্ব পায় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ তদারকের দায়িত্ব পায় কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন। ব্যবস্থাপনা সহায়তা পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পায় যুক্তরাজ্যের হাই পয়েন্ট রেন্ডাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা সেতু নির্মানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের কোম্পানিটি পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায়। পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১০ সালে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হলে সেখানে প্রি-কোয়ালিফিকেশনের জন্য ৪০টি কোম্পানি অংশ নেয়। বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবির তত্ত্বাবধানে এদের মধ্যে ৫টি কোম্পানিকে বাছাই করা হয়। পরে বিশ্বব্যাংকের আপত্তির কারণে একটি কোম্পানি বাদ পড়ে যায়। আর্থিক প্রস্তাব আহ্বান করলে শুধুমাত্র চীনের এই কোম্পানিটি আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়।
এক পর্যায়ে পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণের যৌক্তিকতা ও বাস্তবায়ানুগতা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে দেশজ অর্থনীতিতে সার্বিক সঞ্চয় ও পুঁজি প্রবাহের সক্ষমতা তথা সামষ্টিক অর্থনীতি অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনায় পারঙ্গমতা পরিস্থিতির ওপর। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে বিশ্বব্যাংক এডিবির উপস্থিতিতেই বিদ্যমান অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের হিস্যামতো ২১% আর্থিক সংস্থান যেখানে নানান উপায় উদ্ভাবন সাপেক্ষ ছিল সেখানে সমুদয় ব্যয় নির্বাহ গোটা অর্থনীতির ধারণ ও সহন ক্ষমতার সমীকরণ সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কেননা কারোরই বিনিয়োগযোগ্য অর্থের উৎস অসীম নয় অবশ্যই তা সীমিত ও সীমাবদ্ধ; সুতরাং যে পদ্ধতি প্রক্রিয়াতেই যাওয়া হোক না কেন এই বিশাল পরিমান অর্থের জোগানে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে এবং সহজ শর্তের পরিবর্তে চড়া সুদ/মাশুলসহ কড়া শর্তের পুঁজির দিকে হাত পাততে হয়েছে বা হচ্ছে। তবে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পের নির্মাণে সমগ্র দেশবাসীর আকাক্সক্ষা পূরণে সরকারের দৃঢ়চিত্ত মনোভাবের প্রতি সমর্থন এবং তাদের অয়োময় আবেগ ও প্রত্যয়কে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে পেতে সরকারের প্রচার প্রয়াস, বন্যা প্রপীড়িত এই দারুণ দুঃসময়ে, ইতিমধ্যে সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। দেশের আঞ্চলিক উন্নয়ন সুনিশ্চিতকারী এই মেগা প্রকল্পটি প্রায়োরিটি দিয়ে বাস্তবায়নে সব অঞ্চলের সব মহলের আবেগ ও আকাক্সক্ষাকে সমন্বয় ও সংহতকরণের আবশ্যকতা এবং এর সার্বিক সাফল্য নির্ভর করবে সেতু নির্মাণ ব্যয়ে সাশ্রয়ী ও জবাবদিহির স্বচ্ছতার মাধ্যমে সবাইকে আস্থার শামিয়ানায় শামিলকরণের ওপর।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মায় সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সমগ্র দেশের যে সংযোগ সংস্থাপিত হবে এবং এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের যে পরিবেশ সৃজিত হবে তাতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.২% এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জি-আরডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫% বৃদ্ধি পাবে
লেখক : কলাম লেখক, উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক