রূপাঞ্জন গোস্বামী
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশ। সেই প্রদেশেই আছে হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী। যাকে গ্রীকরা বলতেন ককেশাস ইণ্ডিকাস। সেই হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণীর দুর্গম একটি এলাকার মধ্যে দিয়ে উন্মত্ত গতিতে বয়ে চলেছে কুনার নদী। পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এক অজানা রহস্যের মোড়কে আবৃত। বিশ্বের কাছে সেই রহস্য এখনও পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
তুষারাবৃত হিন্দুকুশের ঘন সবুজ গালিচা মোড়া উপত্যকা দিয়ে পাহাড়ি ঝর্না ছুটে চলেছে আপন খেয়ালে। প্রাচীন ওয়াল নাট, অ্যাপ্রিকট, ওক,পাইন,ফার,উইলো গাছের ভিতর দিয়ে উপত্যকায় নেমে আসে শৃঙ্গ ছোঁয়া মেঘের দল। চারদিকে রঙবেরঙের পাহাড়ি ফুলের শোভা। এমনই এক স্বপ্নের পরিবেশে বাস করে এক স্বাধীনচেতা প্রাচীন শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী।তাঁদের চুল সোনালী, চোখের মনির রঙ নীল। এই মানুষদের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। পাকিস্তানের আর কোনও গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে তাঁদের চেহারা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা ও খাদ্যাভাসের বিন্দুমাত্র মিল নেই। তাঁরা হলেন কালাশ।
পাকিস্তানের চিত্রাল জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি উপত্যকাগুলি হল বুম্বুরেট, রুম্বুর ও বিরির। এই তিনটি উপত্যকায় ছড়িয়ে আছেন কালাশরা। পাকিস্তান থেকে শিখ, হিন্দু, খ্রিষ্টানদের বের করে দেওয়া হচ্ছে, তখন কালাশরা কী ভাবে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। যদিও সংখ্যায় এঁরা মাত্র ৪০০০।
যে তিনটি উপত্যকায় কালাশরা থাকেন, সেখানে সংঘর্ষের ছায়া পড়লেও পৌঁছতে পারেনি মৌলবাদ। এই স্বাধীনচেতা মানুষগুলি পাকিস্তানের শাসন মানেন না। কারণ তাঁরা মনে করেন কালাশ উপজাতি গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যসামন্তের বংশধর। এঁরা লড়াই করে বাঁচতে জানেন। কালাশরা জানেন মরলে লড়াই করেই মরতে হবে, কারও অধীনে থেকে নয়। পাকিস্তানও এদের ঘাঁটায় না।
কারা এই কালাশ!
তাঁরা বলেন তাঁদের পূর্বপুরুষরা গ্রীস থেকে এসেছিলেন। ইতিহাসেও তার অনেকটাই প্রমাণ মিলেছে। ইতিহাসবিদদের মতে, কালাশরা এখন যেখানে বসবাস করেন, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সেই উত্তর পাকিস্তানের পাহাড়ি এলাকা জয় করেছিলেন ২,০০০ বছর আগে। কালাশ জনগোষ্ঠীর মানুষরাও এখানে বাস করছেন প্রায় দু’হাজার বছর ধরেই।
ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত যে ‘কালাশ’ ভাষায় কথা বলেন কালাশ উপজাতির মানুষেরা, তার সঙ্গে আরবী বা উর্দুর কোনও মিল নেই। কালাশরা বলেন, ইসলামেরও আগে সিকান্দার–ই–আজম (আলেকজান্ডার) ভারতে আসেন। যুদ্ধ জয়ের পর তিনি যখন গ্রিসে ফিরে যান, তাঁর কিছু সঙ্গীসাথী এখানেই থেকে যান। হিন্দুকুশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাঁদের ভালো লেগে যাওয়ায়। তাঁদের নেতা ছিলেন আলেকজান্ডারের এক সেনাপতি। তাঁর নাম ছিল শালাখাশ (সেলুকাস!)। তিনি তাঁর কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে পাহাড়ি উপত্যকায় বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় মহিলাদের বিবাহ করেন। হিন্দুকুশের কাফের কালাশরা তাঁদেরই বংশধর।