ডক্টর অরিত্র কোনার:(কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট)
মানুষের শরীরের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্টের বয়সও নিশ্চয় বাড়বে আর পাঁচটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গর মতোই। কিডনি, ফুসফুস, মস্তিষ্ক—সবেরই বয়স বাড়ে প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু এই নিয়ম তখনই বেনিয়ম হয়ে যায়, যখন আমরা আমাদের জীবনযাপনকে পরিমিতির মধ্যে বেঁধে রাখতে ব্যর্থ হই। জীবনযাপনকে সুন্দর ও সুস্থ করে তুললে হার্টের বয়স থামানো যাবে না, তবে হার্টের অসুখ রোখা যেতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়ম করে শরীরচর্চা, ধূমপান না করা, মদ্যপান কমানো, পর্যাপ্ত ঘুম—এরকম প্রাথমিক কয়েকটি বিষয় মেনে চললেই হবে। পাশাপাশি বলব, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, রক্তচাপ—এই ধরনের সমস্যাগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা খুব জরুরি। প্রয়োজনে ওষুধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখেত হবে এই সমস্যাগুলি। তবেই হার্টের অসুখ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
হার্টের প্রধান অসুখগুলির উপসর্গ চিনতে হবে
হার্টের অসুখ প্রধানত তিন ধরনের হতে পারে। প্রথমটা হল, হার্টের ধমনীতে ব্লক হওয়ার কারণে বুকের ব্যথা সংক্রান্ত সমস্যা। যার ফলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। দ্বিতীয়টি হল, হার্টের মাসেল সংক্রান্ত রোগ, যাকে কার্ডিওমায়োপ্যাথি বলা হয়। তৃতীয়ত, হার্টের ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিট আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যাওয়া। তখন রোগীর হার্টে পেসমেকার বসাতে হয়।
ধমনীর ব্লক নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা
এসবের মধ্যে আমরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে সমস্যা পাই, আমাদের সবচেয়ে বেশি চিন্তার কারণ যে অসুখ, তা হল হার্টের ধমনী অর্থাৎ করোনারি আর্টারি ব্লক হয়ে যাওয়ার সমস্যা। এ জন্য বেশ কিছু লক্ষ্ণণ দেখা যায় শরীরে।
করোনারি আর্টারির মধ্যে ধীরে ধীরে লিপিড জমা হওয়ার কারণে যদি ধমনী সরু হতে থাকে, তাহলে হার্টের পেশিতে রক্ত চলাচল ভাল ভাবে হয় না। এর ফলে বুকে ব্যথা হয়। এই বুকে ব্যথাকে আমরা মেডিক্যাল পরিভাষায় বলে থাকি ‘অ্যানজাইনা’।
এখন এই ধমনী ধীরে ধীরে সরু হওয়া একরকম। সমস্যাও ধীরে ধীরে হয়। তখন হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক না হলেও, অ্যানজাইনাল পেন হতে পারে পরিশ্রমের সময়। জোরে হাঁটলে, ভারী কিছু বইলে, সিঁড়ি ভাঙলে এই ব্যথা বোঝা যায়। আবার বিশ্রাম নিলে ব্যথা চলে যায়। একে বলে স্টেবল অ্যানজাইনা বা এফোর্ট অ্যানজাইনা।
তবে কারও যদি হঠাৎ করে রক্তনালি সরু হয়ে ব্লক হয়ে যায়, তাহলে তীব্র বুকে ব্যথা, ঘেমে যাওয়া অজ্ঞান হয়ে যাওয়া—এই ধরনের ব্যাপার হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। এমনটা হলেই দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। নইলে রোগীর হার্টের অবনতি হতে পারে, তার জেরে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ফলে আমরা যদি লক্ষ্য করি পরিশ্রম করার সময়ে বুকে ব্যথা হচ্ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তাহলে সন্দেহ করতে হবে, করোনারি আর্টারি সরু হয়ে যাচ্ছে। এমনটা হলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে, টেস্ট করে, পরিস্থিতি বুঝে ওষুধ খাওয়া ও রেসট্রিকশন মেনে চলা প্রয়োজন।
বুকে ব্যথার নানা ধরন
করোনারি আর্টারি ব্লকের কারণে হওয়া বুকে ব্যথার ধরনও আবার বিভিন্ন রকম হতে পারে। সাধারণত বুকের মাঝখানে শুরু হলেও, পরে তা পিঠের দিকেও হতে পারে ব্যথা। এমনকি বুক থকে ব্যথা ওপরে ছড়িয়ে চোয়াল চেপে ধরার অনুভূতিও হতে পারে। বুক থেকে নীচের দিকে নাভি পর্যন্তও ব্যথা হতে পারে। এমন ব্যথা কিন্তু হৃদরোগের অশনি সংকেত।
কার্ডিওমায়োপ্যাথি
হৃদরোগের দ্বিতীয় ধরন হিসেবে বলা যায় কার্ডিওমায়োপ্যাথি কথা। এই সমস্যায় হার্টের পেশি দুর্বল হয়ে যায়। অনেক সময় হার্ট বড়ও হয়ে যায়। হার্টের যে নিলয় প্রকোষ্ঠ, তার আয়তন বেড়ে যায়। এর ফলে হার্ট ভাল করে পাম্প করতে পারে না রক্ত, যে কারণে শরীরের নানা অংশে বিশেষ করে ফুসফুসে জল জমে যেতে পারে। শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারেন রোগী। এটা ধীরে ধীরে হতে পারে, হঠাৎ করেও হতে পারে। হতে পারে হার্ট ফেলিওরও।
খেলতে খেলতে আচমকা হৃদরোগ!
আর এক ধরনের কার্ডিওমায়োপ্যাথির নাম ‘হাইপারট্রফি’। অনেক সময়ে আমরা শুনতে পাই, কমবয়সি মানুষ বা কোনও খেলোয়াড়, খেলতে গিয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে, হয়তো মারাও গেছেন। এটার প্রধান কারণই হল হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি। এর একটা অন্যতম কারণ হল, হার্টের দুই নিলয়ের মধ্যে যে পর্দা থাকে, সেটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি পুরু থাকা। এটা জন্মগত ভাবে থাকে, একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের থাকতে পারে, বংশ পরম্পরায় পরিবাহিত হতে পারে।
আমরা সাধারণত অল্প বয়সে কোনও উপসর্গ না থাকলে হার্টের পরীক্ষানিরীক্ষা করাই না। সেক্ষেত্রে, এই হাইবারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি আছে কিনা, বোঝা যাবে কীভাবে? আমি বলব, পরিবারের কারও এমন আচমকা হৃদরোগের ইতিহাস আছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। থাকলে তাঁর ভাই, বোন, ছেলে, মেয়েদের স্ক্রিনিং ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে দেখতে হবে। সেটা কম বয়স থেকেই করতে হবে, তাহলেই এড়ানো যাবে বড় অসুখ। ওষুধ বা অস্ত্রোপচার—দুরকমের চিকিৎসাই করা যায় ধরা পড়লে, যাতে হঠাৎ বড় বিপদের মুখে পড়তে না হয়।
হৃদয়ের ছন্দপতন
এর পরে আসে হার্টের ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিটে সমস্যার কারণে হার্টের স্পন্দনের ছন্দ বদলে যাওয়া। ছন্দ বদলে গেলেই হার্টের যে কাজ অর্থাৎ সঙ্কোচন-প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত পাম্প করা, তা ব্যাহত হয়।
হার্ট রেট অনেকটা কমে যায় অনেক সময়ে। সে ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্তচলাচল কমে যায়। এতে আচমকা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন রোগী, মাথা ঝিমঝিম করতে পারে, ব্ল্যাক আউট হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ পড়ে গিয়ে চোট পেতে পারেন। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এমনটা হলে একমাত্র চিকিৎসা পেসমেকার বসানো। এতে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
সমস্যায় চিকিৎসকদের কাছে যান, গুগল নয়
আমি একটাই কথা বলব, অবহেলা করবেন না। প্রতিটা রোগই সম্পূর্ণ না হলেও ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখে বোঝা যায়। কোনও রকম সমস্যা বুঝলে ডাক্তারের কাছে যান, দেরি করবেন না। এখন একটা প্রবণতা হয়েছে, আমরা কোনও উপসর্গ দেখলে গুগল করে রোগনির্ণয়ের চেষ্টা করি। এটা একেবারে উচিত নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা শুরু করুন। এটাও কিন্তু হার্টকে বিপন্মুক্ত রাখার একটা বড় পদক্ষেপ।