Home টপ নিউজ হলি আর্টিজান হামলা মামলায় ৭ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড

হলি আর্টিজান হামলা মামলায় ৭ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড

কূটনৈতিক জোন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় ৭ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। আজ বেলা ১২টার দিকে ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। এছাড়া এ মামলার অভিযুক্ত একজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, গাইবান্ধার জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নওগাঁর আসলাম হোসেন ওরফে আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, কুষ্টিয়ার আবদুস সবুর খান ওরফে  সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, জয়পুরহাটের হাদীসুর রহমান ওরফে সাগর, বগুড়ার রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, একই জেলার মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও রাজশাহীর শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।

৫১ কার্যদিবস শেষে এ রায় প্রদান করা হয়েছে। রায় আদালতে পর্যবেক্ষণে জাপানের একটি প্রতিনিধি দলসহ বিদেশিরা উপস্থিত ছিলেন।

নথি থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১লা জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরায় প্রবেশ করে হামলা চালায় ৫ জঙ্গি। তারা ভেতরে থাকা সবাইকে জিম্মি করে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।

পরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নামে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। সেখান থেকে ১৭ বিদেশি ও চার জন বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়। জঙ্গিরা তাদের কুপিয়ে ও গুলি করে নৃশংস কায়দায়  হত্যা করে।

বিশ্বব্যাপি আলোচিত এই ঘটনার দু’দিন পর গুলশান থানার এসআই উত্তম কুমার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। দু’বছর ২২ দিন তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ২৩শে জুলাই তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবীর সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯ (সংশোধনী ২০১৩) এর ৬(২)/৭/৮/৯/১০/১২/১৩ ধারায় আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। চার্জশিটে অভিযুক্ত ১৩ জন ২০১৬ সালের ১লা জুলাই  থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। জঙ্গি হামলার অভিযোগ থেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রেজাউল হাসনাত করিম ও কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটির ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

ঘটনা সম্পর্কে জানেন কিংবা ঘটনা দেখেছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানেন- এরকম ১১৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ জন সাক্ষী ঘটনার দিন হলি আর্টিজানের ভেতর অবস্থান করছিলেন। তাদেরকে কমান্ডো বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাব উদ্ধার করে। রায় ঘোষণার দিন ধার্য করার আগে এই মামলার ৭৫ টি আলামত আদালত পর্যবেক্ষণ করেন।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৬শে জুলাই সিএমএম আদালত মামলাটি সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বদলির আদেশ দেন। ওই হামলার কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মামলার চার্জশিটে বলা হয়, এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। ভয়াবহ এই হামলায় চিহ্নিত ২১ জনের মধ্যে ৫ জন সরাসরি অংশ নেয়। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র- বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলো। হামলার মূল প্রশিক্ষক (মাস্টার  ট্রেইনার) মেজর জাহিদ কিংবা তানভীর কাদেরি, নুরুল ইসলাম মারজান ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসামী। গুলশান হামলার জন্য বগুড়ার দুই জঙ্গিকে নিয়োগ করে রাজীব আর বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া ও জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধও করে সে। জঙ্গি সাগর সীমান্তের ওপার থেকে আনা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছায়। বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি  দেশ থেকে দু’দফা হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করে এবং সেই টাকা গুলশান হামলায় ব্যবহৃত হয়।

যারা এই হামলা চালিয়েছিলো তারা ৫ থেকে ৬ মাস ধরে পরিকল্পনা করেছিলো।  সেখানে হামলা চালানো জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিলো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আর সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেও জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিলো।  অভিযানে নিহত হলি আর্টিজানের পাচক সাইফুল ইসলামকে শুরুতে সন্দেহের তালিকায় রাখা হলেও তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ তদন্তকারীরা পাননি। এমনকি জঙ্গি হামলার পর আটক হলি আর্টিজানের ডিশ ক্লিনার জাকির হোসেন শাওনের কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম

এ রায় সন্ত্রাসীদের জন্য একটা মেসেজ: মনিরুল

হলি আর্টিজান মামলার রায় সন্ত্রাসীদের জন্য একটা মেসেজ উল্লেখ করে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা একটা মেসেজ পেলো। ভবিষ্যতে এ ধরণের কর্মকাণ্ড ঘটাতে কেউ সাহস পাবে না।

আজ দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ কালে তিনি এ কথা বলেন।

আসামীর মাথায় আইএসের টুপি সাদৃশ্য পরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইএসের কোন টুপি নেই আমাদের জানা মতে। আইএসের সৃষ্টি থেকে এ যাবৎ পর্যন্ত কোনো টুপি তারা তৈরি করেনি। তারপরও তাদের কোন টুপি আছে কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখবো।

পাশাপাশি কারো গাফলতির কারণে এ রকম টুপি এজলাসে এসেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান মনিরুল।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

রায়ে সরকার সন্তুষ্ট : আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় জঙ্গিদের ফাঁসির রায়ে সরকার সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এ সময় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের প্রতীক সম্বলিত টুপি পরে এক আসামীকে এজলাসে যাওয়ার ব্যাপারটি তদন্ত হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার পর আজ দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
আইনমন্ত্রী বলেন, আমি সরকারের পক্ষ থেকে বলছি, আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। এরকম চাঞ্চল্যকর এবং যেসব মামলা দেশের শেকড়ে গিয়ে ধাক্কা দেয়, সেসব ঘটনার বিচার দ্রুত শেষ করতে পারছি, এটাও সন্তুষ্টির কারণ।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনাটি যখন ঘটেছিলো, সেসময়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, এসব অপরাধীদের দ্রুত বিচার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সে কথারই সত্যতা প্রমাণ হলো আজ। আমরা এ বিচার কার্যক্রম ও রায়ে সন্তুষ্ট।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে ওঠে এসেছে এ রায়ের খবর। বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এপি, এএফপি সহ শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন ওয়েবসাইটে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে খবরটি।
বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের প্রতিবেদনে শিরোনামে লিখেছে, ‘২০১৬ সালের ক্যাফে হামলায় ইসলামপন্থি চরমপন্থিদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের আদালত’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ঢাকায় পশ্চিমাদের কাছে জনপ্রিয় এক ক্যাফেতে বর্বর হামলা চালিয়ে ১৮ বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যাকারী সাত ইসলামপন্থি চরমন্থিদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের এক আদালত।

বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে শিরোনাম দেয়া হয়েছে, ‘ক্যাফে হামলায় ৭ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশ’। প্রতিবেদনে লেখা হয়, তাতক্ষণিকভাবে স¤পূর্ণ রায় পাওয়া যায়নি।

তবে রায় প্রদানকারী বিচারক জানিয়েছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হামলার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের বিরোধীতা করেছে। অনেকটা একইরকম শিরোনামে বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, ‘২০১৬ সালে ক্যাফে হামলায় সাত জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশ’। রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে হামলাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গর্হিত হামলা হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এদিকে, কাতার-ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনের শিরোনাম দেয়া হয়, ‘হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলা: সাত জনকে মৃত্যুদণ্ড দিলো ঢাকার আদালত।’ প্রতিবেদনটিতে মামলার সরকারি আইনজীবী গোলাম সারোয়ার খান জাকিরকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়, আমরা তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলাম। শারীরিকভাবে অংশ না নিলেও তারা ওই সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। জার্মানি-ভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে তাদের শিরোনামে লিখেছে, ‘ বাংলাদেশ: ক্যাফে হামলার অপরাধে ৭ ইসলামপন্থি জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিলো বাংলাদেশ’। গোলাম সারোয়ারকে উদ্ধৃত করে তারা লিখেছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আদালত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে। কানাডিয়ান গণমাধ্যম বিএনএন ব্লুমবার্গ তাদের শিরোনামে ক্যাফে হামলাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত থাকায় ৭ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড। প্রতিবেদনটিতে হলি আর্টিজান ক্যাফের এক মালিক আলি আসলানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, তিনি রায়ের আগে অপ্রত্যাশিত কিছু হওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। আসলাম বলেন, এই মামলা নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন বাকি নেই। এটা অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার মতো।