বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
সবার মুখে ঘুরতে ঘুরতেই একটা শব্দ ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ হয়ে গেল। শব্দটা ‘কোয়ারেন্টাইন’। বাংলায় গৃহবন্দি বললেও, ৭ থেকে ৭০ বছরের মানুষ পর্যন্ত সকলের মুখে মুখে ঘুরেছে ‘কোয়ারেন্টাইন’। কিন্তু শব্দ উচ্চারণ করলেও এর মানে কী, এটা বুঝতেই প্রথমদিকে সময় লেগে গিয়েছিল বহু মানুষের। তাই অনলাইন অভিধানে এর মানে খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। দেখতে দেখতে বছরের শেষে কেমব্রিজ অভিধান ঘোষণা করে এটিই দ্য মোস্ট সার্চড ওয়ার্ড।
সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে লকডাউন শুরু হতেই সকলকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়। তখন থেকেই এই শব্দের সঙ্গে অনেকর পরিচিতি ঘটে। এর আগে এই শব্দ মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে দেখা যায়নি। লকডাউনের পর মার্চ মাসের ১৮ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত এই শব্দ সবথেকে বেশি সার্চ করা হয়। নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত ১৪৩০০০ বার অভিধানে এই শব্দটি সার্চ করা হয়েছে।
তবে একইসঙ্গে অভিধানে বদলানো হয়েছে এর মানে। পরিস্থিতির কারণে এর মানেও নাকি বদলে গেছে। বিশ্বের মানুষ এর আগেও মহামারীর সম্মুখীন হয়েছেন। তখনও ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গৃহবন্দি থাকতে বলা হত। কিন্তু তখন কোয়ারেন্টাইন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। শব্দটার মানে একরকম ছিল, কিন্তু পরিস্থিতিতে পরে এর মানে বদলে গেছে বলে, অভিধানেও সামান্য পরিবর্তন এসেছে।
আগে অভিধানে এর মানে ছিল– “কোনও রোগের সংক্রমন রুখতে এবং যাতে কেউ সংক্রামিত না হয় তার জন্য একটা সাধারণ সময়কাল পর্যন্ত কেউ বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবেন না, ঘুরতে যেতে পারবেন না।” আর এখন এর মানে পাল্টে রাখা হয়েছে — “কোনও মানুষ বা প্রাণী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে, তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকলের থেকে দূরে রাখা উচিত, যাতে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে।”
কেমব্রিজ অভিধান পুরস্কারের জন্য পাঁচটি শব্দকে বেছে নেয়। তার মধ্যে ‘কোয়ারেন্টাইন’-এর সঙ্গে ‘প্যানডেমিক’, ‘লকডাউন’-কেও রাখা হয়। কারণ এবছর করোনা ভাইরাসের কারণে এই শব্দগুলোর মানেই বেশিবার অনলাইন অভিধানে খোঁজা হয়েছে।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে চিনের হুবেই প্রদেশে শুরু হওয়া এই সংক্রমণ যখন এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন শোনা যাচ্ছিল, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের মানুষ কোয়ারেন্টাইনের আশ্রয় নিয়েছে। এই কোয়ারেন্টাইন শব্দটির অর্থ কী? আসলে এই শব্দের উৎপত্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেই উৎপত্তি জানলেই এই শব্দের অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হবে।
১৪ শতকে ইউরোপ জুড়ে মহামারীর আকার নেয় ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ। তখন বন্দর-শহর ভেনিসের তরফে একটি বিশেষ নিয়ম জারি করা হয়। বলা হয়, বন্দরে কোনও বিদেশি জাহাজ এলে, বা দেশের জাহাজ অন্য কোথাও বাণিজ্য করে ফিরলে, তীরে ভিড়িয়ে যাত্রীদের নামানোর আগে সেটাকে নোঙর করে সমুদ্রেই রেখে দিতে হবে চল্লিশ দিন। কারণ এই চল্লিশ দিন হচ্ছে অসুখের ইনকিউবেশন পিরিয়ড। কেউ সংক্রামিত হলে তা এই চল্লিশ দিনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখনই তাকে আলাদা করে ফেলা যাবে। তার আগে অবধি জাহাজ-ভরা প্রতিটি মানুষই সম্ভাব্য সংক্রামিত, যার থেকে রোগ ছড়াতে পারে।
তখন প্রযুক্তি ও চিকিৎসা এত উন্নত ছিল না, সহজে পরীক্ষা করে রোগ ধরারও উপায় ছিল না। ফলে কোনও রকম ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এই চল্লিশ দিনের অবরুদ্ধ দশাই রক্ষাকবচ ছিল। চল্লিশ সংখ্যাটিকে ইতালির ভাষায় বলা হয় ‘কোয়ারানতা’। আর সময় মানে ইতালিতে ‘তিনো’। ফলে এই অপেক্ষার সময়টিকে তারা বলতো কোয়ারান-তিনো। সেই থেকে এসেছে কোয়ারেন্টিন বা কোয়ারেন্টাইন শব্দটি।
অর্থাৎ, আপাত ভাবে সুস্থ থাকলেও সম্ভাব্য সংক্রামিত মনে হওয়া মানুষদের জন্যই এই কোয়ারেন্টাইন ব্যাপারটি প্রযোজ্য। যাঁরা বাইরে থেকে দেখতে সুস্থ মনে হয়, কিন্তু তাঁরা সুস্থ হতেও পারেন আবার নাও হতে পারেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো জীবাণু আছে কিন্তু এখনও কোনও ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়নি– এমন ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।
কোয়ারেন্টাইন বিচ্ছিন্ন ও বন্দিদশা হলেও, তা কিন্তু আইসোলেশন নয়। আইসোলেশন হচ্ছে সেই অবস্থা, যখন কারও মধ্যে জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত ভাবে ধরা পড়বে। অথবা ধরা না পড়লেও উপসর্গ থাকবে এবং পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তখনই তাকে শুধু বন্দি থাকার নিদান দিলে হবে না, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। সেই অবস্থার নামই আইসোলেশন।