চৈতালী চক্রবর্তী: বহু বছর ধরে জন্ম নেওয়া একটা সংস্কার যখন মানুষের হাড়ে-মজ্জায় মিশে যায় তখন তাকে তার চেতনা থেকে কোনও ভাবেই আলাদা করা যায় না। যতই হোক অন্ধপ্রথা, বা যতই থাকুক প্রাণের সংশয়। সংস্কার তখন একটা ঐতিহ্যের মোড়কে তার ছাপ রাখতে শুরু করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ঠিক এমনটাই হয়েছে স্পেনের বুর্গোস প্রদেশের ক্যাসত্রিলো দে মুরশিয়া গ্রামে। ছোট্ট গ্রাম, তার আজব সংস্কারের জন্য গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত।
সুপ্রাচীন প্রথা, এখন উৎসবের আঙ্গিকে। স্থানীয়দের ভাষায় ‘এল সল্টো দেল কোলাচো’ (Devil’s jump)বা ‘এল কোলাচো’। পর্যটকদের কাছে ‘বেবি জাম্পিং’। কোলাচো শব্দের অর্থ হল ডেভিল বা শয়তান। এল কোলাচো মানে হল শয়তানের লাফ (The devil’s jump)। এই শয়তান কে বা তার ঠিকানা কোথায় সেটা তো আর কারও জানা নেই, তাই শয়তান সেজে থুড়ি শয়তানের মতো সেজে লাফ দেওয়াই হল প্রথা। শুধু লাফ নয়, নম্বা লাফ। অলিম্পিংয়ের হার্ডল রেসের কায়দায় কচি কচি শিশুদের পর পর ডিঙিয়ে, তাদের উপর দিয়ে লাফ। তেমনটাই চলে আসছে বছরের পর বছর।
আর একটু খোলসা করে বলা যাক। ‘বেবি জাম্পিং’ হল ক্যাসত্রিলো দে মুরশিয়া গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন সংস্কার। স্পেনিয়রা বলেন ঐতিহ্য। শিশুদের শুদ্ধিকরণের একটা প্রথা মাত্র। এই গ্রামের অধিবাসীদের বিশ্বাস জন্মের পরই নানা অশুভ শক্তি ঘিরে ধরে শিশুদের। শয়তান তার একরাশ কালো ছায়া নিয়ে শিশুদের ঠিক ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে। শিশুদের শয়তানের কবল থেকে মুক্ত করতে শয়তানের মতো সেজে শিশুদের ডিঙিয়ে যেতে হয় স্পেনিয় পুরুষদের। শয়তানের মতো সাজটাও অদ্ভুত। লাল-হলুদ বিচিত্র ডিজাইনের পোশাক, হাতে ছড়ি বা চামড়।
সাধারণত জুন মাসকেই বেছে নেওয়া হয় বেবি জাম্পিংয়ের জন্য। তিথি, পাঁজি মিলিয়ে গ্রামের চার্চের সামনের রাস্তা আগে থেকেই ধুয়, মুছে সাফ করে রাখেন গ্রামবাসীরা। নির্দিষ্ট দিনে রাস্তা জুড়ে পর পর পেতে দেওয়া হয় দুধসাদা ম্যাট্রেস। তাদের মধ্যে ব্যবধান হাত কয়েক। গোধুলির ম্লান আলো মিলিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার যখন গাঢ় হতে শুরু করে তখনই শুরু হয় অনুষ্ঠানের কর্মসূচি। খুদেদের নিয়ে হাজির হয়ে যান অভিভাবকরা। ম্যাট্রেসে সার বেঁধে শুইয়ে দেওয়া হয় শিশুদের। বয়স বারো মাসের কম। সদ্যোজাতও রয়েছে। নিয়ম হল, এই ম্যাট্রেসগুলোকে ডিঙিয়ে যেতে হবে ওই লাল-হলুদ ‘ডেভিল’দের। এক লাফে পার হতে হবে এক একটা ম্যাট্রেস।
প্রতিবার লাফের পর শিশুদের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হবে গোলাপের পাপড়ি। স্পেনিয়দের বিশ্বাস এই লাফের ফলে শিশুদের উপর থেকে কালো ছায়া সরে গিয়ে তারা শুদ্ধ হয়ে ওঠে। ফুল ছড়িয়ে নতুন জীবনে স্বাগত জানানো হয় তাদের। তবে লাফ দিতে গিয়ে যদি ঘটে দুর্ঘটনা, শিশুদের তুলতুলে শরীরে উপরেই যদি কোনওভাবে দেহ রাখেন ডেভিলরূপী ব্যক্তিরা, তাহলে কী হবে, সেই উত্তর বোধহয় এখনও অজানা।
সব সংস্কারের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে ইতিহাস। ‘বেবি জাম্পিং’ বা ‘এল কোলাচো’র শুরুটা হয় ১৬২০ সাল থেকে। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বিশেষ প্রথা ‘করপাস ক্রিস্টি’ (লাতিন ভাষায় যার অর্থ ‘যিশু খ্রিষ্টের দেহ’)অনুসারে প্রতি বছর জুন মাসে শুরু হয় শিশুদের শুদ্ধিকরণের এই বিশেষ প্রথা। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা মনে করতে শিশুদের শয়তানের কুনজর থেকে জীবনভর রক্ষা করবে এই প্রতীকী শয়তানরা। শুদ্ধিকরণের ব্যতিক্রমী পন্থা সহজেই মনে ধরে গ্রামের অধিবাসীদের। সেই থেকেই রমরমিয়ে শুরু হয়ে যায় ‘এল কোলাচো’। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভিড়ে এই অনুষ্ঠান এখন আর গ্রামের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নয়। উৎসব আরও আকর্ষণীয় করতে ছোটখাটো কার্নিভ্যালের আয়োজনও করেন গ্রামবাসীরা। বিচিত্র পোশাকে সেজে সেখানে হুল্লোড় করতে দেখা যায় তরুণ-তরুণীদের। স্পেনের ‘বুল ফাইটিং’, ‘লা টমাটিনা’ La Tomatina (Tomato Fight Festival), ‘লাস ফেলাস দে ভ্যালেসিনা’ Las Fallas de Valencia (Festival of Fire)-এর মতোই জনপ্রিয় এই ‘বেবি জাম্পিং ফেস্টিভাল’।
এল কোলাচোকে ঘিরে নানা রকম মতান্তর রয়েছে। অনেকেই বলেন বিপজ্জনক উৎসব। কারওর মতে এই সংস্কার অন্ধবিশ্বাস ছাড়া কিছুই নয়। সামান্য ভুলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। বিপদের গুরুত্ব বুঝে এই ফেস্টিভ্যাল বন্ধ করার নির্দেশও দিয়েছিলেন পোপ বেনেডিক্ট। নিষেধাজ্ঞা আসে আরও নানা মহল থেকে। তবে তাতে বিশেষ কান দেননি ক্যাসত্রিলো দে মুরশিয়ার বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, সারা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে কত রকম উদ্ভট আর বিচিত্র প্রথা। দেশ ভেদে, জনজাতি ভেদে তা ভিন্ন রকম। হোক না সেই প্রথা একটু অন্য রকম, তবুও তো তাতে মিশে রয়েছে আবেগ। সেটাই বা কম কি!