তাপস প্রান্ত
চট্টগ্রাম: অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় উত্তরণ হয়েছে পাসপোর্টের। পাসপোর্ট অফিসজুড়ে সিসি টিভিতে নজরদারি। তাতে পাসপোর্ট অফিসের ভিতরে আর আগের মত ‘দালাল’রা ঘুর ঘুর করার সুযোগ না পেলেও এদের তৎপরতা কমেনি। পরিবর্তন এসেছে কেবল দালালদের কাজের ধরনে।
আগে দালালরা পাসপোর্ট অফিসে, আশেপাশে তৎপর থাকতেন ‘শিকার’ ধরার জন্য। এখনও তারা সমানে সক্রিয়। তবে ভিতরে তেমন না। পাঁচলাইশে অবস্থিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এলাকার অবস্থা সরেজমিনে দেখে তা বেশ বুঝা গেছে।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম-এর সাথে যোগাযোগ করা হলে এ প্রসঙ্গে বললেন যে পাসপোর্ট অফিস এখন শতভাগ সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত। ‘দালালদের কোন সুযোগ নেই এখানে। তবুও আমি দালাল ও অফিসে সিন্ডিকেট করে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। ‘
অনুসন্ধানে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসের আশে পাশে বেশকিছু ভবন এবং পাঁচলাইশ সোনালী ব্যাংক এলাকায় দালালদের বহু আস্তানা।
অবস্থাটা কি?
সালমা আক্তার নিজের এবং ছেলের পাসপোর্ট তৈরির জন্য আবেদন করেছিলেন ২৩ ডিসেম্বর ২০২০ সালে, ডেলিভারী স্লিপ অনুযায়ী ১৩ জানুয়ারী ২০২১ এ পাসপোর্ট ডেলিভারী দেওয়ার কথা থাকলে এখনো হাতে পাননি।
সালমা আক্তারের সাথে কথা বলে জানাযায়, দালাল ছাড়া আবেদন করার কারণে নির্ধারিত ডেলিভারির সময় পার হয়ে গেলেও পাসপোর্ট মেলেনি।
১৩ জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত ৩বার পাসপোর্ট অফিসে গেছেন। কিন্তু প্রতিবারে মোবাইলে এসএমএস আসবে জানিয়ে ফেরত দিয়েছে আমাদের। তিনি আরো বলেন, পাসপোর্ট অফিসের বাইরে এক দালাল আমাদের ৩হাজার টাকার বিনিময়ে ৩দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। দালালেরা যদি ৩দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাইয়ে দিতে পারেন, তাহলে সরকারি বেতনভুক্ত কর্তাদের কাজ কি?
মুছা সওদাগর নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমাদের দেশে দালাল ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। পাসপোর্ট করতে এসে নানা রকম ভোগান্তির সম্মুখিন হতে হয় আমাদের। আসলে এখানে সরকারের কোন দোষ নেই। দোষ সব আমাদের সিস্টেমের।
নিজে অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করে গত ২৮ ডিসেম্বর জরুরি হিসেবে সাত হাজার ২০০ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে এমআরপির জন্য আবেদন প্রবাসী জয়নাল। পাসপোর্ট পাওয়ার কথা ছিল গত ২৮ জানুয়ারী। সময় পেরিয়ে গেলেও তারও পাসপোর্ট হয়নি। তিনি বলেন, ‘দালালের মাধ্যমে ঘুষ না দেওয়ায় পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আমাদের গ্রামের আরেক প্রবাসী দালাল ধরে তাদের চাহিদার টাকা দিয়ে আবেদন করে সময়ের আগে পাসপোর্ট পেয়ে গেছে।
পারভেজ নামে একজন বলেন, নতুন ই-পাসপোর্টের আবেদন দালাল ছাড়া সাধারণ মানুষ জমা দিতে গেলে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ জন্য পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের দালালের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কিছু টাকা বাড়িতি দিলে দালালেরা তাদের অফিসে বসে সব কাজ করে দেন। আমাদেরও কষ্ট কম হয়।
কেবল সালমা আক্তার, মুছা সওদাগর, জয়নাল বা পারভেজের নয়, এমন অবস্থা অনেকেরই।
কাস্টমার পরিচয়ে রাকিবুল নামের এক দালালের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, ৪হাজার টাকা দিলে ৩দিনের মধ্যে হাতে পাওয়া যাবে আটকে থাকা পাসপোর্ট। অফিসে সিসি ক্যামেরা থাকায় এখন আগের মত ওপেন কাজ করা যায়না। আমাদের অফিস আছে, ওখানে চলেন ওখান থেকে সব কাজ পরিচালিত হয়। নতুন পাসপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন সাধারণ ই-পাসপোর্ট করতে ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। পরিস্থিতি বুঝে পুলিশ ভেরিফিকেশনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়। আর জরুরি ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সাড়ে দশ হাজার নিয়ে থাকি।
হিল্লোল নামের আরেক দালাল বলেন, আমরা যেহেতু ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করি আমাদের কাছে কেউ পাসপোর্টের ব্যপারে সাহায্য চাইলে আমরা সাহায্য করি। এতে আমরা কিছু টাকা আমাদের কাজ বাবদ ফি রাখি।
অনুসন্ধানে জানাযায়, দালালদের সিন্ডিকেটের লোক পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে আছেন। দালালদের নির্ধারিত কোড অনুযায়ী পাসপোর্ট প্রিন্ট করা হয় এবং বিকাশের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা লেনদেন হয়। সংঘবদ্ধ দালাল চক্র আর অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারির যোগসাজশে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বাড়তি টাকা। অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফাইল ঘুরতে থাকে দিনের পর দিন। কম সময়ে পাসপোর্ট করিয়ে দেয়ার জন্য পাসপোর্ট প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেয় দালালরা অবস্থা বুঝে।