ড. আহমেদ আবদুল্লাহ
বৃটিশ শাসনামলের পূর্বে মুসলমান শাসনাধীন সময়কালে এদেশের পুলিশ, সৈন্য, বিচার, শাসন, দেওয়ানী প্রভৃতি বিভাগের চাকরিতে ব্যাপকভাবে মুসলমানরা যােগ্যতাসহকারে স্ব-স্ব পদে নিয়ােজিত ছিলেন। লাখ লাখ মুসলমানের জীবিকার বাহন ছিল এসব চাকরি।
কিন্তু ইংরেজ শাসনাধীন সময়কালে এসব মুসলমান তাদের বাসস্থান, চাকরি সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় এবং মুসলমান নিয়ন্ত্রিত সমস্ত পদসমূহে হিন্দুদের নিয়ােগ দেয়া হয়।
সম্ভবত ইংরেজ শাসকদের মনে এই ভয়টুকু বদ্ধমূল ছিল যে মুসলমানরা সরকারী উচ্চ পদসমূহে অধিষ্ঠিত থাকলে পুনরায় ইংরেজদের ক্ষমতা হারাবার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে স্বভাবতই মুসলমান জমিদার, উচ্চপদস্থ সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারী শ্রেণী সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে সে জায়গায় হিন্দু জমিদার, মহাজন ও উচ্চপদস্থ কর্মচারী শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এসব হিন্দু রাজ কর্মচারী নির্ধারিত রাজস্ব ছাড়াও অতিরিক্ত কর আদায় করত।
এসময় জমিদারদের সন্তানদের জন্ম উৎসব, বিয়ে উৎসব এমনকি মৃতের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের জন্যও কর প্রদান করতে হত। বৃটিশ শাসনামলে সম্ভবত সবচেয়ে নির্যাতিত শ্রেণী ছিল কৃষক শ্রেণী। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই বাংলায় নীল চাষ ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে ব্যাপকতা লাভ করে। এ সময় মুসলমান প্রজাদের দিয়ে ব্যাপকভাবে নীল চাষ করানাে হত। ফলে নীল কুঠিয়ালদের সঙ্গে চাষীদের নানারকম বিরােধ দেখা দিত। এসময় মুসলমান তাঁতী সম্প্রদায়ও ইংরেজদের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়।
ইংরেজদের প্রবল ব্যবসায়িক মনােবৃত্তির দরুন বাংলার সমৃদ্ধশালী তাঁতশিল্প ও তাঁতী সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি তাঁতশিল্পকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবার জন্য কোম্পানীর ডিরেক্টররা আইন পর্যন্ত পাস করিয়ে নেয়। মুসলমান শাসনামলে এই উপমহাদেশের রাজভাষা ছিল ফারসী। কিন্তু লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর শাসনামলে (১৮২৮-৩৫) রাজভাষা ফার্সীর পরিবর্তে ইংরেজীকরণ হয়। আর এর মূল হােতা ছিলেন ইংরেজ শিক্ষাবিদ লর্ড মেকলে। এই রাজভাষা পরিবর্তনের দরুন মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত নেতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়।
ইংরেজী চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সরকারী চাকরি হতে সরে দাঁড়াতে হয়। মূলত আকস্মিক এই ভাষার পরিবর্তন মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতির অগ্রগতির ধারাকে স্তব্ধ করে দেয়। ইংরেজদের এই দেশ দখল করার পূর্বে মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট উন্নত ছিল যা সে সময়কার মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হতে অনুমান করা যায়।
যা হােক ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত শিক্ষা পদ্ধতিতে মুসলমানদের ইসলামী ভাবধারাকে সযত্নে উপেক্ষা করা হয়। ফলে মুসলমানরা ইংরেজদের প্রবর্তিত এই শিক্ষা পদ্ধতিকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারেনি। মূলত মুসলমান সমাজকে শিক্ষা সংস্কৃতির সভ্যতা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে দেবার জন্যই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এমন মুসলিম আদর্শ এবং নৈতিক ভাবধারা বিবর্জিত শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়।
ইংরেজদের এই শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তনের দরুন মুসলমানদের স্বকীয় পদ্ধতিতে চালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যায়। স্বয়ং জহর লাল নেহরু তার ডিসকভার অব ইন্ডিয়া গ্রন্থের পূঃ ৩৭৬- ৭৭-এ মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থার এই ক্রান্তিকাল সম্পর্কে আলােকপাত করেছেন।
এমনকি ইংরেজদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ উইলিয়াম হান্টারও তার রচনায় এই অপ্রিয় সত্যকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
-লেখক: জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক