সুইস ব্যাঙ্কের নাম শোনেননি এমন মানুষ আজকের দিনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন খুললেই ‘সুইস ব্যাঙ্ক’ এই নামটার সঙ্গে আপনার প্রাথমিক পরিচয় হয়ে যাবে। আরও মজার কথা, বিশ্বের তাবড় আর্থিক কেলেঙ্কারির গল্পের সঙ্গেই কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে আছে এই সুইস ব্যাঙ্ক। যখনই এই ব্যাংকের নাম উঠে আসে তখনই তার মধ্যে ঢুকে পরে দুনিয়ার বিত্তশালী রাজনীতিবিদ, ফিল্মস্টার বা কুখ্যাত অপরাধীদের নাম। খবরের কাগজ খুললে প্রায়ই দেখা যায়, অমুক রাজনীতিবিদ আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেছেন, আর সেই টাকা সুরক্ষিত রয়েছে সুইস ব্যাঙ্কে। কিংবা বিরাট বড় অপরাধী বা সন্ত্রাসবাদী ধরা পড়েছে তার সমস্ত কালো টাকা গচ্ছিত রাখা আছে কোথায়! না, সুইস ব্যাঙ্কে। এসব দেখে শুনে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে সুইস ব্যাঙ্ক কি অপরাধীদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক? যদি তাই হয় তাহলে আইনব্যবস্থায় নাকের ডগায় এমন একটা ব্যাঙ্ক চলছে কী করে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের জেনে নিতে হবে সুইস ব্যাঙ্ক আর তার অতীত ইতিহাসকে।
একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যাবে, এই ‘সুইস ব্যাঙ্ক’ নামে আসলে আলাদা কোনও ব্যাঙ্কই নেই। আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাঙ্কে গোপন একাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা ছিল। ফ্রান্সের রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকেই এই ব্যবস্থা চালু হয়। সপ্তদশ শতকের শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ ব্যবসায়ীরা সুইজারল্যান্ডে এসে পৌঁছায়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি। জেনেভাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু আর্থিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেই সময়। ১৭১৩ সালে ট্রেড কাউন্সিল অব জেনেভা ব্যাঙ্কিং-এর নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। যে নীতির মূল কথাই ছিল কেবল গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও কাছে একাউন্ট সম্পর্কিত কোনও তথ্য জানানো যাবে না। শুধু তাই নয়, এই নীতিমালায় যারা কর ফাঁকি দেন, তাদেরও সুস্পষ্টভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
১৭৪১ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে সুইজারল্যান্ডের প্রথম ব্যাঙ্ক Wegelin and Co প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরে ১৮৫৪ সালে ৬টি ব্যাঙ্ক মিলে একই ছাতার তলায় সমবেত হয়ে একটি যৌথ সংগঠন তৈরি করে।
উনিশ শতকে সুইজারল্যান্ড সরকার দেশের সমস্ত আর্থিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে এবং আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, এমন সব প্রতিষ্ঠানের তদারকি করতে সুইস ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট সুপারভাইজারি অথরিটি বা সংক্ষেপে এফআইএনএমএ (FINMA) গঠন করেন। এই অথরিটির অধীনে যত ব্যাঙ্ক আছে তাদের সবগুলোকেই একসঙ্গে বলা হয় সুইস ব্যাংঙ্ক। জানলে অবাক হবেন, বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের প্রায় ৩০০ বেশি ব্যাঙ্ক এই এফআইএনএমএ(FINMA)-এর তালিকাভুক্ত।
সুইস ব্যাঙ্কে একাউন্ট কারা খুলতে পারেন?
সুইস ব্যাঙ্ক নিয়ে একটা আবছা ভাসা ভাসা ধারণা আমাদের অনেকেরই। আমরা ভাবি হয়তো বিত্তশালী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ নেতা কিংবা কুখ্যাত মাফিয়ারাই শুধুমাত্র এই ব্যাঙ্কের গ্রাহক হতে পারেন। কিংবা সেইসব মানুষ, যারা নিজের কালো টাকার খোঁজ-খবর কাউকে জানতে দিতে চান না। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। সাধারণ যেকোনও ব্যাঙ্কের মতোই সুইস ব্যাঙ্কেও প্রায় যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। বিশেষ করে যেসব দেশের সরকার অস্থিতিশীল, সেইসব দেশের বাসিন্দারা মূলত আর্থিক সুরক্ষার জন্য সুইস ব্যাঙ্কে একাউন্ট তৈরি করে থাকেন।
গোপনীয়তাই কি প্রধান হাতিয়ার সুইস ব্যাঙ্কের?
সুইস ব্যাঙ্কের আইন অনুসারে একজন ব্যাঙ্কার কোনওভাবেই কোনও গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য অন্য কোথাও প্রকাশ করতে পারবেন না। এমনকি কারোর অ্যাকাউন্ট সুইস ব্যাঙ্কে আছে কিনা তাও ব্যাঙ্কার কাউকে জানাতে পারবেন না। চুক্তি অনুযায়ী সুইস ব্যাঙ্ক যদি কখনও এই গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তাহলে ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নিতে পারবেন গ্রাহক। অভিযোগ প্রমাণিত হলে, একজন ব্যাঙ্কারের সর্বোচ্চ ৬ মাস জেল হতে পারে এবং তার সাথে হতে পারে ৫০,০০০ সুইস ফ্রাঙ্ক অর্থদণ্ড। এই চুড়ান্ত গোপনীয়তার শর্তেই সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সুইস ব্যাঙ্ক।
অবশ্য ইদানীংকালে সুইস ব্যাংকের এই গোপনীয়তার নীতি শিথিল করা হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিছু কিছু দেওয়ানি মামলা, যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা বা মানি লন্ডারিং, কর ফাঁকি অথবা সুইস আইনে যা অবৈধ সেইসব ক্ষেত্রে গোপনীয়তার কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়েছে। তার মানে এইসব ক্ষেত্রে মামলা হলে সুইস ব্যাঙ্ক বাধ্য থাকবে গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করতে।
অনেক ভাবেই একাউন্ট খোলা যায় সুইস ব্যাঙ্কে, তবে গোপনীয়তা রক্ষাই যদি একাউন্ট খোলার মূল কারণ হয় তাহলে নাম্বারড একাউন্ট খোলাই শ্রেয়। ব্যাঙ্কের কিছু হাই অফিশিয়াল কর্মকর্তা ছাড়া এই একাউন্টগুলোর তথ্য সচরাচর জানতে দেওয়া হয়না আর কাউকে। আর যদি কেউ নাম্বারড একাউন্ট খুলতে চান তাহলে তাঁকে অবশ্যই সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে আর পূরণ করতে হবে বেশ কিছু ফর্মালিটিজ। নাম্বারড একাউন্টে প্রাথমিক অবস্থায় কমপক্ষে ১,০০,০০০ ডলার ডিপোজিট করতে হবে। আর বছরে ৩০০ ডলার গুনতে হবে শুধুমাত্র একাউন্ট মেইনটেইনেন্সের জন্যে!
সুইস ব্যাঙ্কে একাউন্ট খোলার যোগ্যতা
এসব শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, যারা বিত্তবান তারাই শুধু একাউন্ট খুলতে পারেন এই সুইস ব্যাঙ্কগুলোতে। এক্কেবারে ভুল ধারণা! ঘটনা হল অনেক সাধারণ মানুষেরই একাউন্ট আছে এই ব্যাঙ্কে। হ্যাঁ, গোপনীয়তার স্বার্থে অনেক দূর্নীতিবাজ এই ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে চায় সত্যিই, কিন্তু শুধু অবৈধ অর্থ রাখা কিংবা অর্থের গোপনীয়তাই সুইস ব্যাঙ্কে একাউন্ট খোলার মূল উদ্দেশ্য নয়। ১৮ বছর বয়সী যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই একাউন্ট খুলতে পারে এই ব্যাঙ্কে। একাউন্ট খোলার পর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয় গ্রাহককে, সেই অর্থের পরিমাণ অবশ্য ব্যাঙ্ক ভেদে ভিন্ন হয়।
সুইস ব্যাঙ্কের একাউন্টে টাকা রাখার সুদের হার কতো জানেন?- ০.৭৫ শতাংশ। রাশির আগে মাইনাস চিহ্নটা দেখে অবাক হবেন না। অন্যান্য ব্যাঙ্কের থেকে এখানেই আলাদা সুইস ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে সুদের টাকা ব্যাঙ্ক দেবে না, উলটে গ্রাহককেই নিজের ট্যাঁক থেকে গুনতে হবে সেই টাকা। এই অদ্ভুত নিয়মের পরও বহু মানুষ টাকা জমা রাখেন এখানে। কারণ সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং সিস্টেমকে পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল ব্যাঙ্কিং সিস্টেম বলা হয়।
আসলে প্রতিদিনের লেনদেনের জন্য কেউ একাউন্ট খোলেনা সুইস ব্যাঙ্কে। এখানে একাউন্ট খোলার মূল কারণই হল গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষা করা। আরও একটা বড় কারণ সুরক্ষা। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে প্রতিদিনের লেনদেন করার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি একাউন্ট খুলতে চান, তাহলে কিন্তু সুইস ব্যাঙ্ক সেই অনুমতি দেবেনা আপনাকে। খোলা বাজারে এইরকম লেনদেনের মাধ্যমে গ্রাহকের গোপনীয়তা ভঙ্গ হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ যে নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এত আয়োজন, তা পুরোপুরি ভেস্তে যেতে পারে।
কোনো গ্রাহক যদি চান তাঁর অর্থের উৎস কেউ না জানুক তাহলে এমন সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে হবে যার শাখা তার নিজের দেশে নেই। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগেও এই ব্যাংকে একাউন্ট খোলার নিয়মে খুব বেশি কড়াকড়ি ছিলনা। অর্থাৎ বিত্তশালী ব্যক্তিরা তাঁদের অবৈধভাবে উপার্জন করা টাকা অনায়াসে সুইস একাউন্টে রাখতে পারতেন। এতে তাঁদের কালো টাকা সুরক্ষিতও হত, আবার সম্পত্তির গোপনীয়তাও বজায় রাখত। কিন্তু এখন নিয়ম বদলেছে। বর্তমানে সুইস ব্যাংক যদি মনে করে আপনার অর্থের উৎসে ঝামেলা আছে এবং এই অর্থ ড্রাগের বা অন্যান্য অবৈধ উৎস থেকে আসা তাহলে তারা একাউন্ট খোলার অনুমতি নাও দিতে পারে।